174199

পুলিশে শত বছরের দৃষ্টান্ত এলিজা শারমিন

শায়েখ হাসান:  বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, জাহানার ইমাম কিংবা সুফিয়া কামালের মতো মহীয়সী নারীরা যুগে যুগে বলে গেছেন নারী জাগরনের কথা। নারী জাগরণের অগ্রদূত এসব মহীয়সীরা নারীর স্বাধীনতার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। সমাজের অন্ধকার পথকে পেছনে ফেলে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পে আওয়াজ তুলেছেন কলমে আর মুখে। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূর করে একই সঙ্গে সমাজ গড়ার প্রেরণা হিসেবে যুগে যুগে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন এসব মহীয়সী নারী। তাদের দেখানো পথে হেঁটেছেন সাহসীরাই। তৈরি করে গেছেন ইতিহাস, হয়েছেন আগামী দিনের প্রেরণার উৎস। তেমনি একজন এলিজা শারমিন।

২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পলিশ একাডেমীর প্রথম মহিলা প্যারেড কমান্ডার ছিলেন তিনি। রাজশাহী পুলিশ একাডেমীতে ২৫তম বিসিএসের (পুলিশ) শিানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের শিাসমাপণী কুচকাওয়াজে এলিজা শারমিন প্যারেড অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এতে অংশ নিয়েছিল এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য। এটি ছিল পুলিশ একাডেমীর শতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। শতবর্ষে শারদা পুলিশ একাডেমীতে যা করেননি কোনো নারী সেই কাজটিই করলেন তিনি। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর বাইরে এটি ছিল নারীর অগ্রগতির আরেকটি বলিষ্ট উদাহরণ। নারীর মতায়নের এটি একটি মাইলফলক।

আজ থেকে দশ বছর আগে যখনকার প্রোপটে এই ঘটনা বলা হচ্ছে, তখন পুলিশে নারীদের নেতৃত্ব দেয়াটা বিরল ঘটনাই ছিল। উদাহরণ দিলে তা পরিষ্কার হবে। ২৫তম বিসিএসে (পুলিশ) ১৯৩জন ছিল সহকারী পুলিশ সুপার (এপিএস)। এর মধ্যে ১৬৩জনই ছিল পুরুষ। মাত্র ৩০ জন ছিল নারী সদস্য। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন এলিজা শারমিন। যদিও এর আগে ২০০৩ সালে ২৩তম বিবিএসে উত্তীর্ণ হয়ে এলিজা শারমিন শিকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রভাষক হিসেবে শিকতা শুরু করেন রাজশাহী কলেজে। কিন্তু এলিজা শারমিনের ছিল চ্যালেঞ্জ নেয়ার আগ্রহ এবং ইচ্ছা। নিজেকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয়। তাই ঠিক করেন পুলিশ পেশায় আসবেন। যেই কথা, সেই বিবিএসে পুনরায় উত্তীর্ণ হওয়ার ল্েয শিক হয়েও অধ্যবসায় শুরু করেন। পুনরায় বিবিএসে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। 

এলিজা শারমিনের মতে, ল্য এবং নিষ্ঠা সফলতার প্রথম মন্ত্র। তার ভাষায়, আপনার ল্য এবং নিষ্ঠা যদি একাগ্র হয়, তবে জয় আপনার সুনিশ্চিত। আমি ঠিক করেছিলাম, আমাকে জয়ী হতে হবে। তাই শিকতার রুটিন কাজের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছি, তার ফলও আমি পেয়েছিলাম। অবশ্য আমার বাবা-মা, সহকর্মীদেরও অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতা ছিল। আমার বাবা একজন শিক ছিলেন। আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন পেশার প্রতি বাবার আগ্রহ এবং একাগ্রতা দেখে আমি শিহরিত হতাম। মুগ্ধ হতাম। তিনি আমাকে সবসময় সাহস যোগাতেন, উৎসাহ দিতেন। এসব সাহস এবং শিহরণ আমাকে পরবর্তীতে চ্যালেঞ্জ নিতে সহযোগিতা করেছে।



এলিজা শারমিনের স্বামী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কর্মকর্তা এমএ ইউসুফ সরকারও তার এই সফলতায় অবাক হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, পুলিশের কঠোর ট্রেনিং অতিক্রমে হয়তো এলিজা সম নাও হতে পারেন, কিন্তু এলিজা শারমিন সফলতার সাথে তা অতিক্রম করেন। স্বামী ইউসুফ সরকারের ভাষায়- এলিজা মানুষ হিসেবে খুবই আন্তরিক। যখন ও কোনো দায়িত্ব নেয়, সে নিষ্ঠার সাথেই তা পালন করে।



জীবনে নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই- কথাগুলো এলিজা শারমিনের। তিনি বলেন- পুলিশের সকল সদস্য সবসময় দায়িত্বের কথা মাথায় রেখেই দিন শুরু করেন। আমাদের কাজের প্রতি সবসময়ই দায়িত্বশীল হতে হয়। কারণ দেশের আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর অংশ আমরা। তবে এই কাজে চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, তেমনি আÍতুষ্টিও অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে বেশি-ই বলে আমি মনে করি।

সফলতার দ্বিতীয় মন্ত্র কি? এলিজা শারমিনের ভাষায়- পেশাকে ভালবাসতে হয়, পেশাগত কারণেই আপনাকে দায়িত্বশীল হতে হয়। এসব েেত্র আমাদের পেশার কোনো বিকল্প নেই। যদি মানুষের জন্য প্রতিমুহূর্তে সরাসরি কোনো কাজ করতে চাই, সেবা করতে চাই তাহলে এই পেশাতেই তা সম্ভব।



মানুষের জীবনে প্রবাহ ঠিক থাকলে তারা ল্েয স্থির থাকে এবং তা থেকে বিচ্যুতি ঘটে না। সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ জীবনের সচলতার একটা বৈশিষ্ট্য। সফলতারও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এলিজা শারমিনের ভাষায়- এটি অবশ্যই সফলতার তৃতীয় মন্ত্র।

এলিজা শারমিনের প্রেরণা কে? এমন প্রশ্নে এলিজা শারমিন বলেন- অবশ্যই আমাদের আগে যারা এই পেশায় এসেছেন, তারা আমাদের প্রেরণা। তবে একটা কথা বলতে পারি- মুক্তিযুদ্ধে প্রথম নারী শহিদ বলা হয় মোসা. মেহেরুন্নেছা নামের একজন মহীয়সীকে। সেই নারীদের ঘরের কোণে থাকার সময়ে বাঙ্গালী প্রথম নারী চিকিৎসক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন ডা. জোহরা বেগম কাজী। এসব বিষয় আমাদের জাতিগত গৌরবের। এসব অর্জন আর দ্বিতীয় কারো সম্ভব নয়, তবে বিষয়গুলো আমি উপলদ্ধি করার চেষ্টা করতাম। সহজ কথায়, আমার প্রেরণা বাংলার মেহনতী মায়েরা-বোনেরা। যারা এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

আগামীতে যারা এই পেশায় আসতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে এলিজা শারমিনের পরামর্শ হচ্ছে- নিজের মন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করো, তাদের জন্য এই পেশা মানানসই। তবে অবশ্যই আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা এই পেশায় ভাল করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন।

পেশাগত জীবনের বাইরেও এলিজা শারমিনের ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে। সেখানে তিনি কঠোরের বিপরীতে পুরোপুরি মমতাময়ী এবং কোমল। ছুটির সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটাতে বেশি ভাল লাগে এলিজা শারমিনের। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া এবং বই পড়া তার শখ।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.