174205

কর্মেত্র নারী পুলিশদের যত চ্যালেঞ্জ

শায়েখ হাসান: নারী পুলিশদের সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও নারী পুলিশরা এগিয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীতে নারী পুলিশ পরিদর্শকের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে, এবং দেশের প্রতিটি থানায় নারী পুলিশদের নিয়ে একটি আলাদা ডেস্ক চালু করা হবে। নারীর এতো সব অর্জনের সামনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি কেউ।

কাজের েেত্র বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং তা থেকে উত্তরণের ল্য মাথায় রেখেই ২০০৮ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল নারী পুলিশ নেটওয়ার্ক। কনস্টেবল থেকে শুরু করে নারী পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই নেটওয়ার্কে যোগ করা হয়েছে। নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল দু’হাজার নারী পুলিশ নিয়ে। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজারে। অর্থাৎ মোট পুলিশের সংখ্যার প্রায় ৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছি। এই নেটওয়ার্কের সভাপতি হচ্ছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস।

নেটওয়ার্কের সেক্রেটারি অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবিদা সুলতানা বলছিলেন, অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে পুলিশে নারীদের চ্যালেঞ্জ খুব একটা কম নয়। তবে এখন এই পেশায় নারীরা অনেক বেশি আসছে। এটি আমাদের জন্য সুখের সংবাদ। তবে এখনো নারী পুলিশ সদস্যদের অনেক জটিলতা রয়েছে। কাজের জটিলতাগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে সবসময়। অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আবিদা সুলতানা এখন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। কিন্তু অফিস না করলেও রোজ করে তার পেশাগত কাজগুলো সেরে রাখতে হয়। এর সঙ্গে রয়েছে ঘর-সংসারও। আবার- নারীদেরও পুরুষ সদস্যদের মতো একই ধরনের ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে হয়। এটি অবশ্যই চালেঞ্জিং। ঈদ এবং এ জাতীয় উৎসবগুলোতে পুরুষ সদস্যদের মতো নারী পুলিশদেরও ডিউটি করতে হয়। যদিও পরে বিষয়টি সমন্বয় করা হয়। কিন্তু উৎসবে প্রিয়জনদের সবসময়ই নারী সদস্যদের মিস করতে হয়।

তিনি বলেন, সদস্যদের মধ্যে আÍবিশ্বাস ও মনোবল তৈরি, দতা বাড়ানো ইত্যাদি উদেশ্যে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিণের আয়োজন করা হয়। যে কোনো পেশায় মানিয়ে নেয়ার জন্য শুধু শারিরীক নয় মানসিকভাবেও তাদের উদ্বুদ্ধ রাখার প্রশিণ দরকার। যাতে তাদের মনোবল থাকে।

পুলিশে নারী পুলিশের অভিষেক ঘটে ১৯৭৪ সালে ৭ জন এসআই এবং ৭ জন কনস্টেবল যোগদানের মধ্য দিয়ে। তখন নারী পুলিশ সদস্যরা কাজ করতেন সাদা পোশাকে। ইউনিফর্মধারী নারী পুলিশের যাত্রা শুরু হয় দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে। ১৪ জন দুঃসাহসী নারীর যোগদানের মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীতে কাজ শুরু করা নারী পুলিশ সদস্যদের বর্তমান সংখ্যা ১১ হাজার ৩৮ জন। মাঝে ১০ বছর পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে নারী পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ বন্ধ থাকে। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে ৮ জন নারী সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নারীদের প্রবেশাধিকার আবার উš§ুক্ত হয়। এর পর খুব দ্রুতই বাড়তে থাকে এ সংখ্যা। সংখ্যার সঙ্গে বাড়তে থাকে নারী পুলিশের সুনাম আর সাফল্যও। প্রসারিত হতে থাকে নারী পুলিশের কর্মেেত্রর ব্যাপ্তিও। বর্তমানে কনস্টেবল থেকে ডিআইজিÑ সব পদেই তাদের সরব উপস্থিতি।

বর্তমানে নারী পুলিশের কাজের ত্রে যেমন প্রসারিত হয়েছে, তেমনি কর্মেেত্র নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নারী পুলিশ। চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে চলা নারী পুলিশের সফলতা এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। একটা সময় ছিল যখন নারী পুলিশ মানেই ছিল শুধু দাপ্তরিক কাজে দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিআইজি, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ডিআইজি, অতিরিক্ত পুলিশ পরিদর্শক, এসপি, অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনারসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন নারী পুলিশ সদস্যরা। নিরাপত্তার পাশাপাশি টেকসই পুলিশি ব্যবস্থা উন্নয়ন, স্থানীয় তদন্তকারীদের উৎসাহিত করতে সহায়তা, অপরাধ, মানুষর ঝুঁকি প্রশমনের পাশাপাশি শত্র“র মোকাবিলায়ও নারী পুলিশ সদস্যরা এখন দায়িত্ব পালন করছেন।

চার দশকের পথচলায় পুলিশ বাহিনীতে নারী সদস্যদের সফলতা অনেক। এখন আর শুধু দাপ্তরিক কাজেই নারী পুলিশ আটকে নেই, সাহসিকতার সঙ্গে তারা এখন ছুটে যাচ্ছেন পথ-ঘাটে, দূর-দূরান্তে। দতার সঙ্গে নীতিনির্ধারণীর দায়িত্ব যেমন পালন করছেন, তেমনি দাপটের সঙ্গে নারী সার্জেন্টরা এখন রাজপথও সামলাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের শান্তিমিশনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের নারী পুলিশরা। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের নারী পুলিশ এখন যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত।

পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও এতদিন পর্যন্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নারী সদস্যদের কাজ করতে দেখা যায়নি। ২০১৬ সালে ২৮ জন নারী সার্জেন্ট যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজপথে কাজ করতে শুরু করেন নারী পুলিশ সদস্যরা। নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০০৮ সালে চালু করা হয়েছে ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক।’ ২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে নারী পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী পুলিশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে।

নারী পুলিশ সদস্যরা অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন শান্তিরা মিশনেও। পুলিশ সদর দপ্তরে তথ্যে পাওয়া যায়- ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরা কার্যক্রমে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরাও। ২০০০ সালে শান্তিমিশনে প্রথম নেতৃত্ব দেন একজন নারী পুলিশ। বর্তমান ডিআইজি (অর্থ) মিলি বিশ্বাস।

বর্তমানে জাতিসংঘের ৯টি মিশনে প্রায় আড়াই হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্বের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হাইতি ও কঙ্গোসহ সুদান, দারফুন, আইভরিকোস্ট, লাইবেরিয়া, সোমালিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে জটিল ও অপারেশনাল দায়িত্বও পালন করছেন শান্তিমিশনে অংশ নেওয়া নারী পুলিশ সদস্যরা। বাংলাদেশের নারী পুলিশকে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন, যা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে শান্তিরায় লিঙ্গ সমতা এসেছে। তবে বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। এখনো পর্যাপ্ত নয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.