এক যন্ত্র দিয়েই ৪০ হাজার অপরাধীর নির্মম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়
ইউরোপের একটি বহুল প্রচলিত মৃতুদণ্ডের মাধ্যম ছিল অপরাধীকে ‘ভেঙে ভেঙে’ হত্যা করা। এই পদ্ধতিতে অপরাধীকে একটি চাকায় হাত পা টান টান করে বাঁধা হত।
এরপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী জল্লাদ আক্ষরিকভাবেই মুগুর দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তার শরীরের সব হাড়গুলো ভেঙে ফেলত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া জন্য তাকে জনসম্মুখে নানা ভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে হত্যা করা হত।
আর এই হাড় ভাঙার সময় জল্লাদ অপরাধীর এমন জায়গায় আঘাত করত, যাতে করে তার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু না হয়। সে হাত কিংবা পায়ের মতো স্থানের হাড়গুলো আগে পিটিয়ে ভেঙে নিত।
এরপর আস্তে আস্তে পিটিয়ে অপরাধীর দেহের সমস্ত হাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলত জল্লাদ। ফলে একসময় অমানবিক যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যু হতো অপরাধীর। এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ফলে জঘন্য ও লোমহর্ষক এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটত।
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন কীভাবে গিলোটিন দিয়ে নির্মমভাবে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত। আজকে শেষ পর্বে থাকছে এই গিলোটিন যন্ত্রটি কীভাবে আবিষ্কার করা হয়েছিল সে বিষয়ে-
ডা. গিলোটিন ও তার সহকর্মীরা হালিফ্যক্স গিব্বেট ও স্কটিশ মেইডেন নামের দুটি পূর্ববর্তী শিরচ্ছেদ যন্ত্র থেকে নতুন ও উন্নত একটি যন্ত্র তৈরির অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পূর্বের এ দুটি যন্ত্রই ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটেনে প্রচলিত ছিল।
তবে এই যন্ত্রগুলোতে বিশাল আকারের কুড়ালের মাথা ব্যবহার হত। ভোঁতা এই অস্ত্রটি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করে শিরচ্ছেদ করা হতো যা মোটেই পরিচ্ছন্নভাবে সম্পন্ন হত না। এভাবে কয়েক মাস যাবার পরে ল্যাক্যুইয়ান্তে নামের স্ট্রাসবার্গ ক্রিমিনাল কোর্টের একজন অফিসার একটি যন্ত্রের নকশা তৈরি করেন যেটি বিখ্যাত গিলোটিনের প্রকৃত রূপ।
তার এই নকশা কমিটির সবারই খুব পছন্দ হয় ফলে তারা এটির একটি আনুমানিক ক্ষুদ্র সংস্করণ বা প্রোটোটাইপ নির্মাণ করার জন্য টোবিয়াস স্কিমিড নামের এক জার্মান প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেন।
টোবিয়াস সেই নকশায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে আরো উন্নত রূপে একটি যন্ত্র নির্মাণ করেন। তিনি এটিতে ৪৫ ডিগ্রী কোণে একটি লম্বা ব্লেড যুক্ত করেন। নির্মাণের পর অ্যান্টনি লুইসের নামে যন্ত্রটির নাম দেয়া হয় ‘লুইসেট্টে’। পরে তার নাম বদলে যে মানুষটি এই যন্ত্রের প্রথম প্রস্তাবনা করেছিলেন সেই ডা. গিলোটিনের নামে এই যন্ত্রটির নাম গিলোটিন রাখা হয়।
পূজা-পার্বণে হাড়িকাঠে বিভিন্ন পশু বলি দেয়া হত, গিলোটিন ছিল অনেকটা তেমনই। একটি সুদৃশ্য কাঠের উপর উপুড় করে অপরাধীকে শুইয়ে দেয়া হত। তার গলাটি গোল করে কাটা হাড়িকাঠের মধ্যে আটকানো থাকত। এবার তার মাথার উপর থেকে ৪৫ ডিগ্রী কোণে বাঁকানো একটি ধারালো ভারী ব্লেড ছেড়ে দেয়া হত। ফলে নিমেষেই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত মাথা।
গিলোটিনের মাধ্যমে প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিলে। নিকোলাস জ্যাকুইস পেল্লেটিয়ার নামের এক দস্যুকে এই দিন মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেয়া হয়। বিপুল পরিমাণ দর্শক নতুন এই পদ্ধতির মৃত্যুদণ্ড দেখতে ভিড় করেন। পেল্লেটিয়ারকে গিলোটিনে চড়ানো হয়।
এর কয়েক সেকেন্ড পরেই নেমে আসে মৃত্যুর সেই ব্লেড। আর সঙ্গে সঙ্গেই ধড় হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার মাথা। তবে এতদিন পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেখে অভ্যস্ত উপস্থিত জনতার সবাই এই মৃত্যুদণ্ড দেখে হতাশ হয়ে পড়ে।
তারা এতদিন ফাঁসি কিংবা ‘ভেঙ্গে ভেঙ্গে’ মৃত্যুদণ্ডের মতো যেসব পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেগুলোতেই বেশি বিনোদন লাভ করত। গিলোটিনের এই দ্রুত শিরচ্ছেদ পদ্ধতিকে তারা ‘বেশি দ্রুত’ ও বিনোদনহীন আখ্যা দেন।
অসন্তুষ্ট জনতার মধ্যে অনেকে তো চিৎকার করেই বসেন, এই গিলোটিন আমরা চাই না! আমাদের পুরানো সেই ফাঁসি কাঠ ফিরিয়ে আনা হোক! অন্যকে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে দেখেও যে মানুষ কতটা পাশবিক আনন্দ পায় সেটি বোঝা যায় এ ঘটনা থেকে।
জনগণের অপছন্দের হলেও এই গিলোটিনকেই ফ্রান্সের একমাত্র বৈধ মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর গিলোটিন আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যেই ফরাসি বিল্পবের কুখ্যাত ‘রেইন অব টেরর’ সময়কালের প্রধান প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এই গিলোটিন।
এক বছরের মধ্যেই গিলোটিনের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের শিরচ্ছেদ করা হয়। বহু বিখ্যাত ব্যক্তিকে এসময় গিলোটিন চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ডা. গিলোটিনও খুব অল্পের জন্য বেঁচে যান তার প্রস্তাবিত এই গিলোটিনে নিজের মুন্ডু হারানোর হাত থেকে!
জনসম্মুখে গিলোটিনে শেষ মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করা হয় ১৯৩৯ সালের ১৭ জুন ভার্সাইল্লেসে। এসময় ইউগেন উইল্ডম্যান নামের এক জার্মান অপরাধীকে কারাগারের বাইরে গিলোটিনে চড়িয়ে শিরচ্ছেদ করা হয়। সেসময় উপস্থিত জনতা এই দৃশ্যে এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন যে, এরপর থেকে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
তবে গোপনীয়ভাবে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত গিলোটিনের ব্যবহার চলতে থাকে। এরপর সেই বছরেরই ১০ সেপ্টেম্বর মারসেইল্লিতে গিলোটিনের মাধ্যমে সর্বশেষ মৃত্যুদণ্ডটি কার্যকর করা হয়।
হামিদা জানদৌবি নামের এক তিউনিসীয় অভিবাসীকে নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের অপরাধে এই দিন গিলোটিন চড়ানো হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নেমে আসে ব্লেড। আর সেই সঙ্গে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গিলোটিনের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হওয়া শেষ নরমুণ্ড।