269190

৩০০ বছর ধরে মাছ শিকার করা হয় ভোঁদড় দিয়ে

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এটি একটি প্রবাদ। যে প্রবাদে বাঙালির পরিচয়কেই তুলে ধরা হয়েছে। এ পরিচয় হাজার বছরের। একবেলা মাছ ছাড়া যেন খাওয়াই হয়না। আর আমাদের দেশে মাছ শিকারের রয়েছে অনেক পদ্ধতি। ছিপ ফেলে বড়শিতে গেঁথে কিংবা বিভিন্ন ধরনের জাল ফেলে। এই দুই পদ্ধতি বেশি প্রচলিত হলেও গ্রামাঞ্চলে রয়েছে আরো বেশকিছু পদ্ধতি। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় টেটা বা কোঁচ, পলো, ঘূর্ণি। এছাড়াও পৃথিবীর নানা দেশে মাছ ধরার অভিনব সব পন্থা রয়েছে।

পাখি দিয়ে মাছ শিকার করা হয় সুদূর চীন এবং জাপানে। প্রায় ১৩০০ থেকে ১৫০০ বছর ধরে তারা মাছ শিকারের এই পুরনো প্রথা মেনে আসছে। জাপানে ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিকে করমোর‌্যান্ট ফিশিং বা উকাই বলা হয়। ঠিক ই শুনেছেন পাখি দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। আমাদের দেশে কিন্তু একসময় ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা হতো। কেতাবি নাম এশীয় উদ্বিড়াল বা ছোটনখী ভোঁদড়। স্থানভেদে ছোট এ প্রাণীটি উদবিলাই, উদ, ধেরে, ধারিয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা বেশ পুরনো ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য এটি। তবে কালের বিবর্তনে এ পদ্ধতি আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

মাছ ভোঁদড়ের প্রিয় খাদ্য

মাছ ভোঁদড়ের প্রিয় খাদ্য

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবনের নদীগুলোর এবং চিত্রা নদীর পাড়ের বেশ কিছু জেলে পরিবার এখনো ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারের প্রথা টিকিয়ে রেখেছেন। নড়াইল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ভোগরা, গোয়ালবাড়ি, রতডাঙ্গা, পঙ্কবিলাস আর গোয়ালবাড়িরসহ আরো কয়েকটি গ্রামে ভোঁদর জেলেরা বাস করছে। ভোঁদর দিয়ে মাছ ধরার এ পেশা চলে আসছে বংশানুক্রমে। বলা হয়ে থাকে, উদ্বিড়াল দিয়ে মাছ ধরার এ পদ্ধতি ৩০০ বছরের পুরনো। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নৌকা আর ভোঁদড় নিয়ে নদীপথে পাড়ি জমান স্থানীয় জেলেরা। এ সময় খাল-বিলের পানি কমে যায় বলে মাছ পাওয়া যায় বেশি। ভোদর জেলেদের বেশিরভাগই মাছ ধরতে অতীতে শীত মৌসুমে সুন্দরবনে পাড়ি জমাতেন। তবে জলদস্যুদের ভয়ে এখন সুন্দরবন যেতে চান না তারা।

বিড়ালের মতো দেখতে ছোট উভচর এ প্রাণী মাছ শিকারে পটু। মাছই এদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। পুকুর বা বিলে মাছ শিকার করে এরা।জেলেদের নৌকার একপ্রান্তে বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি করা ঘরে ভোঁদড় আটকে রাখা হয়। মাছ ধরার জন্য জেলেরা সাধারণত দলে ভাগ হয়ে নেন। প্রতিটি দলে তিন থেকে পাঁচজন জেলে, একটি জাল এবং কম পক্ষে তিনটি ভোঁদর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতিটি দলে দুটি পুর্ণবয়স্ক এবং একটি কমবয়সী ভোঁদর থাকে। মাছধরার জন্য ত্রিভুজ আকৃতির জাল ব্যবহার করেন তারা।

নদীতে জাল ফেলার সময় ভোঁদড়ের ঘরের দরজা খুলে দেয়। জালের দুইপাশ নামিয়ে দেয় পানিতে। ভোঁদড়ও জালের সঙ্গে নেমে পড়ে পানিতে। পানিতে নেমে ভোঁদড় মাছকে তাড়িয়ে জালের মধ্যে নিয়ে এলে জেলেরা জাল টেনে ডাঙায় ওঠান। উদ্বিড়াল জালে মাছ তাড়ানোর সময় শিকার করে না বা কোনো মাছ খায়ও না। জাল তোলার পর সেখান থেকে তাদের যে ছোট মাছ খেতে দেয়া হয়, সেগুলোই কেবল খায় তারা। ভোঁদড়কে জেলে পরিবারগুলো অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখির মত লালন-পালন করেন। শিকারে যাওয়ার আগে ভোঁদড়কে মাছ খাওয়ানো হয়। আবার জালে যেসব মাছ ধরা পরে তার একটি অংশও ভোঁদড় পায়। ফলে সে জেলেদের প্রতি থাকে বিশ্বস্ত।

একেকটি দলে থাকে তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক ভোঁদড়

একেকটি দলে থাকে তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক ভোঁদড়

বাংলাদেশের নদী জলাশয় থেকে দিনে দিনে মাছ কমে যাওয়ায় দুর্দিন চলছে ভোঁদর জেলেদের। এছাড়াও বাড়ছে জলদস্যুদের উৎপাত। তাই এখানকার জেলেরা পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন এখন। জেলেদের পেশা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাণীগুলোর বিলুপ্তির আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। আবার জেলেদের ভোঁদরের সংকটও আছে। জেলেদের প্রতিটি ভোঁদর সংগ্রহ করতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। একেকটি ভোঁদর বেঁচে থাকে প্রায় ২০ বছর। দেখতে অনেকটা বিড়ালের মত এই প্রাণী ওজনে ৩ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী ভোঁদর প্রতি বছরে একবার তিন থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বেশ দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী হয় একেকটি ভোঁদর। প্রাকৃতিকভাবে নড়াইল ছাড়াও খুলনা, সিলেট এবং পাবর্ত্য অঞ্চলে ভোঁদর পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ভোঁদর পাওয়া যায়, যাদের বেশীরভাগই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। তবে মাছ শিকার করতে লুটরা পেরসপিসিল্লাটা নামের প্রজাতিটি মাছ শিকারে ব্যবহৃত হয়। এই স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখতে অনেকটা বিড়ালের মতো।

ভোঁদড় ছানা

ভোঁদড় ছানা

বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীর চামড়ার মূল্য অনেক বেশী হওয়ায় পাচারকারী চক্র বেশ সজাগ দৃষ্টি রাখে জেলেদের উপর। জেলেদের অনেকেই তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেন ভোঁদর। আবার স্থানীয় মানুষের নানা কুসংস্কার আর অসচেতনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাণীটি। পুকুরের মাছ খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে অনেকেই লোকালয়ের আশেপাশের ভোঁদর মেরে ফেলতে উদ্যত হোন। বর্তমানে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত ভোঁদড়ের ব্যাপারে একটি আইন ২০১২ সালে পাস হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, “এই আইনটি পাস হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে কোনো ব্যক্তির কাছে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত কোনো বন্য প্রাণী থাকলে সেগুলো নিবন্ধনের আওতাভুক্ত করতে হবে”। ত্বে বর্তমানে দেশে কী পরিমাণ ভোঁদর আছে তার কোনো রেকর্ডও নেই। তাই এই বন্যপ্রাণীটি অবহেলা আর অনাদরেই থকে যাচ্ছে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ পেশায় জেলেদের কিটিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে দিতে হবে সরকারি সহায়তা।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.