268592

শত বছরের দারপ্রান্তে রসমালাই, আজো স্বাদ পাল্টেনি

অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে শুভ কোনো কাজ সবেতেই মিষ্টিমুখ না করলে কি হয়! ভারতবর্ষে মিষ্টির প্রচলন প্রায় হাজার বছরেরও আগে। তবে ভোজন রসিক বাঙালির খাওয়ার পর মিষ্টি ছাড়া চলেই না। একেক অঞ্চলের রয়েছে একেকটি বিখ্যাত মিষ্টি। এরমধ্যে রসমালাই কমবেশি সবারই পছন্দ।

রসমালাইয়ের কথা আসলেই শুরুতে আসে কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের বিখ্যাত রসমালাইয়ের কথা। রসমালাই বঙ্গে তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ারও জনপ্রিয় একটি মিষ্টান্ন। আমাদের দেশসহ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালে রসমালাই রয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে বাংলাদেশের কুমিল্লার এবং ভারতের কলকাতার রসমালাই খুবই বিখ্যাত।

১৪৯৮ সাল। সম্পূৰ্ণ সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হলেন ইতিহাসের প্ৰথম ইউরোপিয়ান পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা। ভারতে দলবল সহ তিনি অবস্থান করেন ১৫০৩ সাল পর্যন্ত। সাগরে ঘুরে ঘুরে যারা সভ্যতার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। দুধের সঙ্গে একটু টক দিলেই যে দুধ  ছানা হয়ে যায় এই কৌশলও বের করে তারা। যদিও ছানা থেকে মিষ্টি বানানোর কৌশল বের করতে পারেননি তারা। ১৭ শতাব্দীতে এসে রসমালাইয়ের প্রচলন হয় বাংলায়।

মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই

মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই

তবে এর আগে বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদিকে দেবতার আহার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অবশ্য ছানা আবিষ্কারের আগেই  ভারতবর্ষে বেসন, নারকেল ও মুগের ডালের সঙ্গে চিনি সংযোগে মিষ্টান্ন তৈরির রীতি প্রচলিত ছিল। ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি মতিচূর লাড্ডুর বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এসে চিনির সঙ্গে ছানার রসায়নে জন্ম হয় আধুনিক সন্দেশ ও রসগোল্লা। এরপর ১৯ শতকের প্রথম দিকে ক্ষীরভোগ বেশ পরিচিতি পায়। তখন ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে এই মিষ্টান্ন তৈরি করত।

অনবরত নেড়ে নেড়ে, দুধ জ্বাল দিয়ে গেলে একসময় তা ঘন হয়ে বাদামী রং ধারণ করে। যার নাম মূলত ক্ষীরের রসা। এই ক্ষীরের রসায় রসগোল্লাকে একটু ছোট করে মার্বেল সাইজ বানিয়ে ডুবিয়ে দেয় ঘোষেরা। ক্ষীরের রসায় রসগোল্লার ডুব সাঁতারে এক অনবদ্য মিষ্টান্ন তৈরি হয়। এর নাম দেয়া হয় ক্ষীর ভোগ। এই ক্ষীর ভোগ তুমুল জনপ্রিয়তা পেলো সেসময়।  তবে ক্ষীর ভোগ নামটি টিকলো না বেশিদিন। প্রচলিত হয়ে গেলো একটি নতুন নামে। সেটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মিষ্টির ইতিহাসে’র এক নতুন অধ্যায়। অপূর্ব, স্বর্গীয় স্বাদের সেই মিষ্টির নাম হয়ে গেল রস মালাই।

মাতৃ ভান্ডারের দোকান

মাতৃ ভান্ডারের দোকান

কুমিল্লা একসময় ভারতের বর্তমান রাজ্য ত্রিপুরার অংশ ছিল। বর্তমান নোয়াখালীও তখনকার সময়ে কুমিল্লার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন ত্রিপুরাকে সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল নিয়ে নেয় কুমিল্লার। ১৭৮১ সালে নোয়াখালীকে কুমিল্লা থেকে পৃথক করা হয়। দেশ ভাগের পর ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা। ত্রিপুরা রাজ্যে ততদিনে রসগোল্লা মিষ্টির রাজা হিসেবে ব্যাপক আকারে জনপ্রিয়।

সময়টা ১৯৩০ সাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া খড়িয়ালার সন্তান খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামীয় দুই ভাই জীবিকা অন্বেষণে আসেন কুমিল্লা শহরে। কুমিল্লার কেন্দ্রস্থল মনোহরপুর এলাকায় বিখ্যাত রাজ রাজ্যেশ্বরী কালী মন্দিরটির অবস্থান। সেখানেই তারা একটি মিষ্টির দোকান খুলে বসলেন। তখন ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান ভারত দেশ বিভাজনের ১৭ বছর আগের কথা। দোকানের নাম দিলেন মাতৃ ভান্ডার। একসময় ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন তারা। খুব অল্প দিনের মধ্যে তাদের রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

দোকানে ভিড় লেগেই থাকে

দোকানে ভিড় লেগেই থাকে

যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান এবং মিষ্টিপ্রিয় মানুষের কাছে রসমালাই এক প্রিয় নাম হয়ে ওঠে। এই রসমালাই এখন কুমিল্লার ঐতিহ্যের অংশ। এই দোকান থেকেই সর্বপ্রথম রসমালাইয়ের আনুষ্ঠানিক বিপণন শুরু হয়। এজন্য রসমালাই এর জন্মসাল ধরা হয় ১৯৩০। দাবী করা হয় বাঙালি ময়রা কৃষ্ণচন্দ্র দাস প্রথম রসমালাই তৈরি করেন। তবে এই দাবীর স্বপক্ষে জোরালো কোনো  প্রমাণ নেই। তবে ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিল্লার অন্যান্য ঐতিহ্যের পাশাপাশি মাতৃ ভান্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারা দেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়ন করা হয় এই রসমালাই দিয়ে।

মনিন্দ্র সেন বিয়ে করেননি। খনিন্দ্র সেন ওয়াপদার চাকুরি ছেড়ে মাতৃ ভান্ডার মিষ্টি দোকানটি দেন। দোকান শুরুর পর থেকে তাদের পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনো। খনিন্দ্র সেনের ছিল দুই মেয়ে এক ছেলে। তার বড় ছেলের নাম ছিল শংকর সেনগুপ্ত। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ের নাম স্মৃতি সেন। দেশ ভাগের আগেই ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা যান। পিতার অবর্তমানে দোকানের হাল ধরলেন শংকর সেনগুপ্ত। শংকর সেনগুপ্ত বার্ধক্যজনিত কারণে এখন অসুস্থ।

আজো বদলায়নি এর স্বাদ

আজো বদলায়নি এর স্বাদ

তার সন্তান অনির্বাণ সেনগুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। এই মিষ্টি ব্যবসায়ের তিনিই এখন একমাত্র উত্তরাধিকারী। বাবু রাখাল চন্দ্র দে বর্তমানে মাতৃ ভান্ডারের তত্ত্বাবধায়ক। শংকর সেনগুপ্ত মূলত একজন স্বল্প ভাষী মানুষ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই মানেই দোকান রয়েছে বহু। যাদের সঙ্গে আসল মাতৃ ভান্ডারের কোনো সম্পর্কই নেই। তবে আসল মাতৃ ভান্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদ আজো পূর্বের ন্যায় অক্ষুণ্ন রয়েছে।

মাতৃ ভান্ডারে রসমালাই যেভাবে তৈরি করা হয়

কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই তৈরির প্রক্রিয়া খুবই সহজ। একটি পাতিল বা কড়াইয়ে এক মণ দুধ দুই ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিলে তা ঘন হয়ে ১৩/১৪ কেজি ক্ষীর তৈরি হয়। এর দুধ থেকে পাওয়া ছানার সঙ্গে কিছু ময়দা দিয়ে খামির তৈরি করে বানানো হয় ছোট ছোট রসগোল্লা। এক কেজি ছানাতে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা দিতে হয়। এক মণ দুধ দিয়ে ১৪ কেজির মতো রসমালাই বানানো যায়। এখন রসদানা তুলে এনে মালাইতে মেশানোর পালা। এরপর ঘণ্টা তিন চারেক মালাইয়ে রসগোল্লার ডুব সাঁতার। ব্যাস তৈরি বাঙালির রসনাতৃপ্তির অন্যন্য উপকরণ রসমালাই।

মাতৃ ভান্ডারে রসমালাই তৈরি করা হচ্ছে

মাতৃ ভান্ডারে রসমালাই তৈরি করা হচ্ছে

রসমালাই ও (জিআই) আইন

সারাবিশ্বে খ্যাতি থাকলেও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পায়নি রসমালাই। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা সংক্ষেপে জিআই হচ্ছে মেধাসম্পদের অন্যতম শাখা। কোনো দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া, জলবায়ু এবং ওই দেশের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি অনন্য গুণমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই গুণমানসম্পন্ন সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী হলেও দীর্ঘ সময় ধরে জিআই আইন না থাকায় এ দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মালিকানা সুরক্ষার সুযোগ ছিল না।

মাতৃ ভান্ডারে গীতা পাসি

মাতৃ ভান্ডারে গীতা পাসি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন, ২০১৩ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। এরপরই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য নিবন্ধনের পথ সুগম হয়। ডিপিডিটি দেশের প্রথম ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে জামদানিকে জিআই নিবন্ধন দিয়েছে। পরবর্তী সময় জাতীয় মাছ ইলিশ জিআই সনদ লাভ করেছে। দেশের তৃতীয় পণ্য হিসেবে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আম’ জিআই নিবন্ধন পাবে। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই আমাদের পণ্য হিসেবে জিআই আইন দ্বারা অতি দ্রুত নিবন্ধিত হওয়াটা ভীষণ জরুরি। ডিপিডিটির তথ্য মতে, বাংলাদেশে এ রকম আরো দেড় শতাধিক পণ্য রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কুমিল্লার রসমালাই।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.