268287

লাখো ধর্ষিতার রক্ত শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আফ্রিকান আমেরিকানরা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর লাতিন আমেরিকার ভয়ঙ্কর দাস প্রথা নিয়ে সবাই কমবেশি জানেন। আমেরিকাই ছিল ট্রান্স আটলান্টিক থেকে আসা আফ্রিকান দাসদের ভবিষ্যৎ। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে দাস প্রথা না থাকলেও এদের রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো আফ্রিকান আমেরিকানরা। আমেরিকার আফ্রিকানরা বেশিরভাগই সেসময়ের দাসেদের বংশধর।

জানেন কি? আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার পূর্ব পুরুষেরা দাস হিসাবে এসেছিলেন আমেরিকায়। অথচ অবাক করা ব্যাপার তাদের বংশধর আজকে আমেরিকার ফার্স্ট লেডি। এছাড়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিৎসা রাইসের প্রমাতামহকে মাত্র চার বছর বয়সে দাসী হিসাবে বিক্রি করা হয়েছিল ৪৫০ ডলারে। এছাড়া অপ্রাহ উইনফ্রে, অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান ও বক্সার মোহাম্মদ আলীর মত কিংবদন্তীদের পূর্বপুরুষ দাস হিসাবেই এসেছিলেন আমেরিকায়।

ব্রাজিলের ছন্দময় ফুটবল কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারদাঙ্গা ক্রিকেটের ভক্ত নিশ্চয় আপনিও? এ খবর জানেন কি? ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল, ব্রাভোরা কিন্তু সেই ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেডের সময় ধরে আনা দাসদের বংশধর। ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের পূর্বপুরুষও কিন্তু ছিলেন দাস। এছাড়া পৃথিবীর দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টের আদিপুরুষ আফ্রিকান দাস।

তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী দাসরাই শুধু আটলান্টিক পাড়ি দিতে সক্ষম হত। তারাই কঠোর পরিশ্রম করে টিকে থাকতে পারত। বংশগতির সূত্রমতে তাদের সন্তানরাও হত তাদের মতই শক্তিশালী ও কষ্টসহিষ্ণু। ক্রীড়াঙ্গনে আফ্রো-আমেরিকানদের ব্যাপক সাফল্যের কারণ কিন্তু এটাই।

নির্মম দাস প্রথা

নির্মম দাস প্রথা

তবে এখন তাদের ভাগ্য বেশ ঝকঝকে হলেও ট্রান্স আটলান্টিকের ক্রীতদাসদের অতীত বেশ ভয়াবহ। সেসময় শারীরিক, মানসিক অত্যাচার ধর্ষণ, মৃত্যু ছিল তাদের নিত্য দিনের ঘটনা। এগুলো কমবেশি পুরো বিশ্বের জানা। তবে নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, দাস ব্যবসায়ের নৃশংসতার প্রমাণ। আফ্রিকান আমেরিকানদের ডিএনএতেও মিলেছে দাস প্রথার অত্যাচারের নিদর্শন।

আমেরিকান জার্নাল অব হিউম্যান জেনেটিক্সে প্রকাশিত ভোক্তা জেনেটিক্স সংস্থা ২৩তম একটি গবেষণায় ট্রান্স-আটলান্টিক ক্রীতদাস ব্যবসায়ের পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা নতুন তথ্য দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সেসময় যে পরিমাণে কৃষ্ণাঙ্গ নারী দাসরা শ্বেতাঙ্গ মালিক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল তার সংখ্যা ব্যাপক। ধারণা করা হয়, আমেরিকায় যত সংখ্যক দাস বাণিজ্য হয়েছে তার থেকে প্রায় তিনগুণ বেশি নারী শ্বেতাঙ্গ মালিক দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল।

এই গবেষণায় আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং আটলান্টিক আফ্রিকা থেকে ৫০ হাজারের বেশি লোকের জেনেটিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। কোন এলাকা থেকে কীভাবে তারা এসেছে সবকিছুই রেকর্ড করা হয় নতুন এই গবেষণায়। সেখান থেকেই উঠে আসে ভয়াবহ এসব চিত্র। সেসময় এসব ক্রীতদাসীরা যে পরিমাণ আমেরিকান শিশু জন্ম দিয়েছে, তা লাতিন ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য আমেরিকায় ইউরোপীয় বংশদ্ভূত শিশুর চেয়েও দ্বিগুণ ছিল।

এর থেকেই স্পষ্টত হয়ে উঠেছে, আফ্রিকান দাস নারীরা কতটা যৌন অত্যাচার সহ্য করেছে আমেরিকানদের থেকে। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রবি পেরি বলেছেন, এই কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা প্রায়শই তাদের মনিবদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ সাধারণত কাজের লোকদের দাসত্ব বজায় রাখতে বাচ্চা জন্ম দিতে বাধ্য করেছিল। তবে এদের পিতৃপরিচয় দেননি কেউ।

আফ্রিকানদেরকেই দাস বানানো হত

আফ্রিকানদেরকেই দাস বানানো হত

অন্য এক গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে বর্ণগত কারণে সাদারা আফ্রিকানদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যেই তারা আফ্রিকান জাতিকে ইউরোপীয় দাস হিসেবে নিয়ে আসে। গবেষকরা তাদের কাজের উদ্দেশ্য সফল করতে দাস প্রথার আরো কিছু নিদর্শন তুলে ধরেন। এর মধ্যে দাস প্রথার জাতীয় নীতিমালা, পাশাপাশি দাসত্বপ্রাপ্ত পুরুষদের উচ্চ মৃত্যুর হার, দাসত্বপ্রাপ্ত নারীদের দ্বারা সন্তান জন্মদান রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় আফ্রিকানদের মধ্যে নাইজেরিয়ার বংশধর সবচেয়ে বেশি। এটি পাওয়া যায় জাহাজের নথি থেকে। আমেরিকানরা দাসত্বের অর্থনীতি বজায় রাখার জন্য সম্ভবত ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান থেকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত করেছিল। যে কারণে ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে আগত নাইজেরিয়ার দাসত্বপ্রাপ্ত লোকদের বংশধরদের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়।

আমেরিকায় আফ্রিকানদের দাসত্বের শুরু 

ইউরোপ থেকে দাস বোঝাই প্রথম জাহাজটি আমেরিকায় পৌছায় ১৫০২ সালে। সেটি ছিল একটি স্প্যানিশ জাহাজ। শুরুর দিকে দাস ব্যবসা পুরোপুরি ছিল পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশদের হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স সমানতালে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পরে।

তবে আর একটু পেছনে ফিরে দেখলে জানা যায়, এর কারণও। সময়টা ১২ অক্টোবর ১৪৯২। মানব সভ্যতার গতিপথ বদলে দেয়ার একটি দিন। এই দিনে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সেদিন থেকেই সূচনা ঘটে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের। আমেরিকা আবিষ্কার হওয়ার পর ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মতো ইউরোপীয়রা ছুটে আসতে শুরু করল সদ্য আবিষ্কৃত এই মহাদেশে।

স্থানীয় আদিবাসীদের একটু একটু করে সরিয়ে দিয়ে দখল করতে লাগল তাদের জমি। ইউরোপের মানুষের কাছে এত উর্বর জমি যেন কল্পনার অতীত। প্লেগ ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তৎকালীন ইউরোপে আবাদি জমির ছিল বড্ড অভাব। তাই এই সুযোগ লুফে নিতে শুরু করল ইউরোপবাসী। একই সঙ্গে শুরু হলো ব্যাপক কৃষিকাজ এবং স্থানীয়দের উপর অত্যাচার।

তবে বিশাল দুই মহাদেশের হাজারো মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করার মতো জনবল তাদের ছিলনা। সেই সমস্যার পৈশাচিক সমাধান বের করা হলো আফ্রিকা থেকে লাখো মানুষকে দাস হিসাবে ধরে এনে। আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ আমেরিকায় দাস ধরে আনার এই ব্যবসা ইতিহাসে ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড হিসাবে পরিচিত।

নজর পড়ল কালো এই জাতির সুঠাম দেহের প্রতি। তাদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে থাকলো ইউরোপীয়রা। শুরু হলো দাস প্রথা। অনেকটা বাধ্য করেই এই প্রথা চালু করে তারা। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া দাস ব্যবসা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়ে আফ্রিকার প্রায় দেড় কোটি থেকে দুই কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময় মারা যায়।

তাদের উপর করা হত নির্মম অত্যাচার

তাদের উপর করা হত নির্মম অত্যাচার

প্রায় ৮০ লাখের মতো দাস আনা হয়েছিল শুধু ব্রাজিলেই আর চার লাখ যুক্তরাষ্ট্রে। বাকিদের হাইতি ও ক্যারিবীয় অন্যান্য দ্বীপগুলোতে পাঠানো হয়েছিল। সাধারণত দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল যেটা সেনেগাল থেকে অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দাস ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ছিল বেনিন, টোগো এবং নাইজেরিয়ার পশ্চিম উপকূলে। তাই এলাকাগুলোকে স্লেভকোস্ট বা দাসের উপকূল বলা হত।

যুদ্ধবন্দী, অপরাধী, ঋণগ্রস্ত ও বিদ্রোহীদেরকে স্থানীয় আফ্রিকানদের কাছ থেকে দাস হিসাবে কিনে নিত ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অনেক সাধারণ মানুষকেও দাস ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে দাস হিসাবে বেচে দিত। মোট ৪৫টির ছোট বড় জাতিগোষ্ঠি থেকে দাস ধরে আনা হত। এদের বেশিরভাগই ছিল আদিবাসী বা আফ্রিকার স্থানীয় সংস্কৃতির অনুসারী।

যুগে যুগে অনেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন দাস প্রথা বিলুপ্তকারী যোদ্ধা হিসেবে। এর মধ্যে রানি আনা এনজিঙ্গার কথা মনে আছে নিশ্চয়। তিনি ছিলেন এনডোঙ্গোর রানি। বর্তমানে যেটি অ্যাঙ্গোলা নামে পরিচিত। ১৬২৪ সালে আনা এনজিঙ্গা তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর এনডোঙ্গো রাজ্য শাসনের অধিকার পায়।

তাদের সন্তানদেরকেও দাস বানানো হত

তাদের সন্তানদেরকেও দাস বানানো হত

সেই সময়ে পর্তুগিজরা এনডোঙ্গো এবং আশেপাশের অঞ্চল দখলের চেষ্টা করে যাতে বেশি পরিমাণ কালো মানুষকে বন্দী করে দাস-বাজারে বেচা যায়। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় আনা এনজিঙ্গা পর্তুগীজ আক্রমণে রাজ্য ছাড়া হয়ে পড়েন। তবুও তিনি মাতাম্বা নামে পাশের একটি রাজ্য জয় করতে সক্ষম হন। আনা এনজিঙ্গা দীর্ঘদিন অ্যাঙ্গোলাতে পর্তুগিজ বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছেন কালো মানুষদের মুক্ত করতে।

চেষ্টা করেছিলেন পর্তুগিজদের হাতে বন্দী কালোদের মুক্তির জন্য আশ্রয় এবং উপায় বের করতে। সময়ও বুঝি বৈরি, কালো মানুষদের মুক্তির দিশারী আনা এনজিঙ্গা মারা যান ১৬৬৩ সালে। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রভাবের সঙ্গেই পর্তুগিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তি সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

মাতাম্বার সঙ্গে পর্তুগিজ বাহিনীর সমঅধিকারের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দূর করতে পেরেছিলেন দাস বাণিজ্য। এই মহান বিদ্রোহী স্বাধীনতাকামী আনা এনজিঙ্গার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২০০২ সালে অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডাতে তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যে এই মহান নারী প্রতিরোধ এবং সাহসের নিদর্শন বহন করে দাঁড়িয়ে আছেন।

এমন আরো অনেক প্রতিবাদীর নাম রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। যাদের অবদানে আজ দূর করা সম্ভব হয়েছে দাস প্রথা। দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে একটি জাতি। পূর্বসূরিদের কষ্টের কোথা স্বীকার করেই নিজেদের এক শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন তারা আমেরিকায়। হয়েছেন আফ্রিকান আমেরিকান। নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে সমাজের উঁচু উঁচু স্থানে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.