225019

একজন অলক কাপালি এবং অনেক সম্ভাবনার এক হারানো ক্রিকেটার

প্রতিভার ঝলকে এই অলকই একদিন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখাতেন!

ডেস্ক রিপোর্ট : ডিপিএল টি-টুয়েন্টির দ্বিতীয় সেমি-ফাইনাল ম্যাচ দেখছিলাম। প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ৩১ বলে ৫৫ রানের চমৎকার একটি ইনিংস খেললেন অলক কাপালি। ছয়টি চারের সাথে তিনটি ছয়ের ইনিংসে স্ট্রাইক-রেট ১৭৭.৪১।

অলকের ব্যাটে এরকম ইনিংস দেখে নস্টালজিক হয়ে যাই। কালেভদ্রে এখন আলোচনায় আসেন, একমাত্র বিপিএল ছাড়া এখন অলকের খেলা টিভিতে দেখার সুযোগ হয়না, ‘১৫ বিপিএলের ফাইনাল ছাড়া এই মুহুর্তে উল্লেখযোগ্য কোন বিপিএল ইনিংস মনে পড়ছেনা আমার। হয়তো আছে, আমি ভুলে গিয়েছি।

অথচ এই রকম চোখ ধাঁধানো ইনিংস নিয়মিত খেলবেন অলক একসময় সেই স্বপ্নই দেখেছিলো দেশের ক্রিকেট ফ্যানরা।

বাংলাদেশের অসংখ্য অপচয়িত মেধার মাঝে একটি নাম “অলক কাপালি”, প্রতিভার দারুন ঝলক দেখিয়ে সেটার পূর্ণতা দিতে না পারা অনেক ক্রিকেটারের ভেতর অন্যতম হতাশার এক নাম অলক।

কিন্তু এই অলকের ভেতর বাংলাদেশ খুঁজেছিল একজন ক্ল্যাসিক মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান, একজন কার্যকরী লেগ-স্পিনিং অলরাউন্ডার, একজন দূর্দান্ত ফিল্ডার।

বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো কথাগুলো শুনে অবাক হবেন, ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখে হেসেই উড়িয়ে দিবেন আমার উপরের কথাগুলো। স্বাভাবিক।

তবে, যারা ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট ফলো করতেন শুধুমাত্র তারাই জানেন কি পরিমাণ প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার ছিলেন তিনি।

২৮ জুলাই ২০০২ সালে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেক হয় ১৮ বছরের তরুণ অলক কাপালির। অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৭২ বলে ৩৯ এবং ৮৬ বলে ২৩ রানের দুটি ইনিংস খেলে সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন। টেস্ট খেলার টেম্পারমেন্ট নাই বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের, বহুল প্রচলিত এই কথার বিরুদ্ধে জবাব দিতেই যেন নেমেছিলেন। দারুন শট সিলেকশন শুধু নয়, বল লিভ করার বেলাতেও নজর কাড়েন তিনি। মুরালি, ভাসদের সামলেছিলেন ভালোই। বল হাতে দুটি উইকেট নিয়েছিলেন।

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলেন সাউথ আফ্রিকা সফরে যেয়ে। অপর প্রান্তের যাওয়া আসার মিছিলের মাঝে করেন ৩৫ (৪৬) রান। আর পরের টেস্টে অলককে ৩৮* (৬৪) রানে রেখেই অল-আউট হয় বাংলাদেশ। অন্য ইনিংসে ২৩ রান করেন ৪৩ বলে, ক্যালিসের বলে আউট হবার আগে।

এরই মাঝে ঘটে ওয়ানডে অভিষেক, ক্যারিয়ারের মাত্র চতুর্থ ওয়ানডেতে অস্ট্রেলয়ার বিপক্ষে ৭৫ বলে ৪৫ রান করেন ব্রেট লি’র বলে বোল্ড হবার আগে। বাংলাদেশ করেছিলো ১২৮ (বা ১২৬) রান। অস্ট্রেলিয়ার ভয়ংকর বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে আই-ক্যাচিং কিছু শট খেলেছিলেন। বাউন্সার সামলান ভালো ভাবেই।

২০০২ সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন কাপালি। ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বেশ নীচে ব্যাট করে ১৯ বলে ২০ রান করেন, তবে এম. এ. আজিজ স্টেডিয়ামে তৃতীয় ম্যাচে ৯৩ বলে ৮৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেছিলেন। রান তাড়া করার সেই ম্যাচে অন্যপাশ থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট আসলে হতে পারতো দারুন কিছুই!

আর টেস্ট সিরিজে ঢাকায় ৯৪ বলে ৫২ রানের পর চট্টগ্রামে ১১১ বলে ৮৫ রানের পাল্টা আক্রমণ করা একটি ইনিংস খেলেন। উইন্ডিজ বোলারদের বাউন্সারগুলোকে পারফেক্ট টাইমিং করা পুল শটে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন সাবলীলভাবে। সেঞ্চুরি যখন নিশ্চিত মনে হচ্ছিলো তখনই আরেকটি পুল করতে গেলে গ্লাভস ছুঁয়ে বল চলে যায় কিপারের কাছে। তবে এখনো চোখে ভাসে অলকের পুল দেখে বাউন্ডারি লাইনের বল বয়রা ব্যাট দিয়ে সেটার শ্যাডো শট দেখাচ্ছিলো টিভিতে। দারুণ! কমেন্ট্রি বক্সে ইয়ান বিশপ বলছিলেন

“হ্যাঁ, এভাবেই পারফেক্ট পুল করতে হয়! “

২০০৩ সালের পাকিস্তান সফরে দুইজন তরুণ নজর কাড়েন, অলক কাপালি আর রাজিন সালেহ। ব্যাট, বল, ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করেন। বিশেষ করে ফিল্ডিং, এই দুজনের হাত গলে একটা সিঙ্গেল বের করাটাও কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য অলকের বর্তমান ভূড়ি দেখে সেই কথা মনে করা অসম্ভব প্রায়!

টেস্টে ১০৬ বলে ৪৬ রানের একটি ইনিংস ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি তবে ওয়ানডে সিরিজে কিছু ভালো ইনিংস খেলেছিলেন। পাঁচ ইনিংসে ২৬, ৩৭, ৬১, ১২ এবং ৬৯ রান করেন।

তবে টেস্ট সিরিজে সেই ঐতিহাসিক হ্যাট্রিক করেন কাপালি। ১৯ বছর ২৪০ দিনে হ্যাট্রিক করে সর্বকনিষ্ঠ হ্যাট্রিকের রেকর্ড গড়েন, বাংলাদেশের প্রথম। সাব্বির আহমেদ, দানেশ কানেরিয়া এবং উমর গুলকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে।

মাঝে ভয়াবহ সেই বিশ্বকাপ খেলেন, কানাডা, কেনিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ের দিন যথাক্রমে ১৯ এবং ১৮ রান করেন, ভাসের ঐতিহাসিক হ্যাট্রিকের দিন ৩২ রান করেন।

ঢাকায় টিভিএস ট্রাই-নেশন সিরিজে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭১ রান করেন। ২০০৩ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের দুই ওয়ানডে ম্যাচে ৩৪ এবং ৪৯ রান করেন।

এরপর ফর্ম হারান অলক। সেই ফর্ম ফিরে পান ২০০৬ সালে, ফতুল্লায় ৫৭ বলে ৫৫ রান করে।

অলকের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সুন্দর ইনিংস আসে ভারতের বিপক্ষে, ২০০৮ সালের এশিয়া কাপে। ম্যাজিকাল এক ইনিংস খেলেন সেদিন। ভারতীয় বোলারদের উপর চড়াও হয়ে ৮৬ বলে সেঞ্চুরি করেন (তৎকালীন বাংলাদেশী দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড)। ৯৬ বলে ১১৫ রান করেন অলক। যেটা এখনো আমার দেখা অন্যতম সেরা ওয়ানডে ইনিংস। শেষ দিকে অলক কতটা মারমুখী ছিলেন তা বলে বোঝানো যাবেনা। এর ঠিক আগের ম্যাচেই শ্রীলংকার বিপক্ষে ৩০ বলে ৩৭ রানের আরেকটি ক্যামিও খেলেছিলেন।

এরপর আসলো সেই আইসিএল কান্ড। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্বে আইসিএল খেলতে যান অনেক ক্রিকেটার। যার ভেতর আফতাব, শাহরিয়ার নাফিসদের পাশাপাশি অলক কাপালিও ছিলেন। আইসিএলে হায়দেরাবাদ হিরোজের বিপক্ষে ৬০ বলে ১০০ রান করেছিলেন।

নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, আবার ফিরেছিলেন ২০১১ সালে। ততদিনে অলকের ঝলক বিলুপ্তপ্রায়, ফেরার পর ৪ ওয়ানডে ম্যাচে রান করেন যথাক্রমে ১৩, ২০, ২০ এবং ১২ রান।

যাইহোক পরিসংখ্যান দেখেই বুঝবেন অলক অভিষেকের প্রথম দেড় দুই বছর বেশ ধারাবাহিক থাকলেও সামগ্রিকভাবে খুবই অধারাবাহিক ছিলেন। এটাই হয়েছে অবশ্য আমাদের শুরুর দিকে। আমাদের বেশিরভাগ ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। তামিম-সাকিবদের ব্যাচটা আসার আগে বেশিরভাগ প্রতিভাবানের গল্পটা তাই হতাশারই।

হয়তো অল্প বয়সের তারকাখ্যাতির সাথে তারা মানাতে পারতেননা, অথবা তাদের সাথে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করা হতো, সেসময় খুব কম প্লেয়ারের নির্দিষ্ট পজিশন ছিলো ব্যাটিং অর্ডারে। উপরে সমস্যা? তাহলে অলক-আশরাফুলদের উপরে তুলে দাও, মিডলে সমস্যা? তাহলে মিডলে নামায় দাও! এমনকি সাত-আটেও নামানো কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিলোনা। আবার হতে পারে অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ তারা নিতে পারেননি।

থাক সেসব, কারন খুঁজে লাভ নাই। তবে এটা মানতে হবে অলক কাপালি আমাদের অনেক বড় একটা স্বপ্ন ছিলো একসময়, তাকে এখনো অন্যতম সেরা “ন্যাচারালি ট্যালেন্টেড প্লেয়ার” মানা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক কোচিং বা বিকেএসপি’র নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে অলকরা উঠে আসেনি, সহজাত প্রতিভা বললে ভুল হবেনা তাই।

ভালো একজন অল-রাউন্ডার হবার সম্ভাবনা ছিলো তার। মাঝে মাঝে হাত ঘুরিয়ে ওয়ানডেতে ২৪ উইকেট শিকার করেছিলেন লেগ-স্পিন বল করে (সেরা ৪৯/৩)।

অকালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে হতাশায়, তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে অলক অবশ্যই একজন বাংলাদেশী লিজেন্ড।

ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৮৭৯৭ রান করেছেন, সেঞ্চুরি করেছেন ২০ বার। সর্বোচ্চ ২২৮ রান।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ৩৬ ক্যাচ কিছুটা সাক্ষ্য দেয় অলক বেশ ভালো ফিল্ডার ছিলেন, তবে যারা দেখেছেন শুধু তারাই বুঝবেন। বাকিরা অবশ্য বুঝবেন না, কাভারে অলকের সেই ডাইভ! দ্রুত পিক করে উইকেটে থ্রো!

তবে অলক আমাদের ইতিহাসে জড়িয়ে থাকবেন আরো একটি কারনে, সেই বিখ্যাত মুলতান টেস্টে কপালে বল লাগার পর রক্তাক্ত অলকের মাঠ ছাড়া এবং প্রায় ফুলে এক চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থায় সেলাই নিয়ে আবারো মাঠে ফেরা কিভাবে ভুলি? আর কিভাবেই বা ভুলি সেই অবস্থায় অলকের দেয়া ক্যাচটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক রশিদ লতিফের ক্যাচের আবেদন এবং অলকের আউটের ঘটনা। রশিদ অবশ্য এই কেলেঙ্কারিতে পরবর্তীতে ৫ ম্যাচ নিষিদ্ধ হন।

অলক কাপালিদের নিয়ে লেখাটা ঝুঁকিপূর্ণ, হুট করে একজন বলে বসবে ১৯.৬০ গড়ের ব্যাটসম্যান নিয়ে এতো কথার কি আছে! আরেকজন বলবে কয়টা সেঞ্চুরি আছে? এসবের তো উত্তর হয়না। পরিসংখ্যান শুধু একটা সংখ্যা, যেটা দিয়ে হয়তো আমরা ক্রিকেটারদের “মান” বিচার করি।

কিন্তু একজন ক্রিকেটারের শুরুর গল্প, সম্ভাবনা, তাকে ঘিরে সেই সময়ের প্রত্যাশা এসব কি আর পরিসংখ্যান বলতে পারে!

অলককে দেখলে তাই মাঝে মাঝে নস্টালজিক হয়ে যাই। ক্লাস সেভেন-এইটের আমাদের কাছে তখন অলক অনেক কিছু ছিলেন যে! অনলাইন বাংলা ম্যাগাজিন-নিয়ন আলোয় থেকে

পাঠকের মতামত

Comments are closed.