180668

মেয়ের যৌতুক মেটাতে এখানে বিয়ে করেন বাবা

সুদানের দারফুরে মাইলের পর মাইল ফাঁকা ধু ধু মরুভুমি আর মাঝারি উচ্চতার পাথুরে পাহাড়। পাহাড়ের ফাঁকে ১৫/২০টা ঘর নিয়ে সুদানিজদের গ্রাম।

এখানে ছোট গ্রামের মাতবরকে বলা হয় ‘শেখ’। এর চেয়ে বড় হলে তার প্রধান ‘উমডা’। ঘরগুলো সব নলখাগড়ার মতো গুল্ম দিয়ে তৈরি, চারদিক মাটি দিয়ে লেপা। এখানে বিস্তৃত মাঠ থাকলেও চাষাবাদের পর্যাপ্ত বীজ ও কৃষি উপকরণ না থাকায় ফসল উৎপাদন নেই। যতটুকু ক্ষেত-খামার আছে তাতে ফসল ফলায় কেবল নারীরা।

সুদানিজ পুরুষরা আলসে এবং এরা ঘরে বসে থাকে বা গাছের নিচে বসে তাস খেলে, গল্প-গুজব করে বা গাঁজা-ভাং খেয়ে ঝিম মেরে থাকে। নারীরা সংসারের সব কাজ করে। ফসলের জমিতে কাজ করা থেকে শুরু করে দোকান সাজিয়ে ব্যবসা বা চা বিক্রি করে বা উৎপাদিত সবজি ও ফল বেচাকেনা করে।

নারীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গাধার পিঠে সওয়ারি হয়। ছোট ছোট বাচ্চারা প্যান্ট পরা, গাড়িতে চড়া কাউকে দেখলেই ‘গুরুজ’ কিংবা ‘মনি’ বলে একটানা টাকা চাইতে থাকে। এদের চেহারা আর বেশভুষা দেখলে খুব মায়া হয়, কষ্টে হৃদয় ভাঙে। একটু ‘ময়া’ অর্থাৎ পানির জন্য এরা দূর-দূরান্তে ছুটে চলে গাধা নিয়ে বা পায়ে হেঁটে।

মহাগরীব হলেও এরা খুব ঈমানদার। কাউকে এরা ঠকানোর চিন্তা করে না। স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে দেখেছি- ভাগে ভাগে আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, লেবু, টমেটো নিয়ে সুদানিজ নারীরা বসে আছে। আপনি কিনবেন এক ভাগ, সে আপনাকে দেবার সময় ভালো করে চেক করে দেবে। খারাপটা রেখে তার পরিবর্তে ভালো আরেকটা দেবে, এরপর অতিরিক্ত ১/২টা আপনাকে দিয়ে দেবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদের চরিত্র মিলিয়ে দেখলে আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন।

খার্তুমে রাস্তার পাশে খেজুর বিক্রেতা খোলা খেজুর বেচেন। কিন্তু দেখেছি ওজনের বাটখারা বা দাঁড়িপাল্লা নেই, একটা টিনের কৌটোতে মেপে খেজুর বেচেন। ধরা যাক এক কৌটো খেজুরের দাম ২৫ পাউন্ড। আপনি নিজেই কৌটোয় খেজুর বেছে বেছে উঠাবেন, কৌটো ভরে উঁচু পিরামিড হবে। এরপরও যত খেজুর ওই পিরামিডের উপর উঠবে বা উঠাতে পারবেন, সবটাই আপনার! বিস্মিত হতেই হয়। অন্যান্য মালামাল কেনার ক্ষেত্রে অবশ্য ইলেকট্রিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা হয়।

মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় এরা যে যেভাবেই থাকুক নামাজ পড়ে। সব কাজ ফেলে, খাবার রেখে আজান হলেই নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। একজনের সাথে আরেকজনের দেখা হলে সালাম দিয়ে ‘সাদিক, কাইফা হাল?’- বলে।

অপরজন সালামের উত্তর দিয়ে ‘তামাম’ মানে ভালো আছি বলে। এরা একজন আরেকজনের কাঁধের উপর বা পাশে হাতে হাল্কা চাপড় মেরে হাতে হাত মিলায় এবং ডান বুকের সাথে ডান বুক মিলায়। নারীরা নারীর সঙ্গে সালাম বাক্য বিনিময়ের পর গালে গাল লাগায়।

সুদানে এসে দেখি এরা নামাজে এরা টুপি এক্কেবারে পড়ে না, যদিও মসজিদে অনেক টুপি থাকে। পাঞ্জাবি, গেঞ্জি বা স্লিভলেস টি-শার্ট গায়ে চাপায় এরা। পায়জামা, ফুলপ্যান্ট, ট্রাউজার বা থ্রি-কোয়ার্টার পড়ে। মসজিদের ইমামকে দেখেছি পাঞ্জাবি বা গেঞ্জির সাথে ট্রাউজার বা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়তে। এভাবেই এরা দিব্যি নামাজ পড়ছে।

তবে আশ্চর্য এক পাঞ্জাবি দেখা যায় সুদানিজদের গায়ে। এটা আমাদের পাঞ্জাবির মতো না, অনেকটা জোব্বার মতো। দুই পাশের দুই পকেটতো আছেই, এরপর বুকের ডানপাশ বা বামপাশে একটু আড়াআড়ি ভাবে পাঞ্জাবির সামনে ও পেছনে প্রস্থে কম, দৈর্ঘ্যে লম্বা একটা করে পকেট। এটার কারণ পাঞ্জাবির নির্দিষ্ট করে সামনে বা পেছন পাশ নাই, গায়ে চড়ালেই চলে! আজানের সাথে সাথেই নামাজের একামত দেয়। ইমাম সাহেব নামাজ শুরু করেন। কি ফজর, কি যোহর, কি মাগরিব- সব নামাজের ক্ষেত্রেই এক নিয়ম।

সুদানে ১৯৯১ সালে শরিয়াহ আইন চালু হয়। কেউ অপরাধ করার কথা চিন্তাও করে না। প্রতিটি বাড়ি চারদিকে বেড়া বা দেয়াল দেওয়া। রাজধানী খার্তুমে এক সপ্তাহ থেকেও আমার কোন পুলিশ বা পুলিশের গাড়ি চোখে পড়েনি। খার্তুমের মাঝ দিয়ে বৃহত্তম নীলনদ প্রবাহিত, এখানে কিছু মাছ পাওয়া যায়। দেশের আর কোথাও নদীও নাই, মাছও নাই।

এখানে পুরুষের বিয়ে করার জন্য কনের বাবাকে পণ বা যৌতুক দিতে হয়। যৌতুকের পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। কনের বাবা ওই পণের টাকা দিয়ে নিজে আরেকটা বিয়ে করে। ঘরে বিবাহযোগ্য ছেলে থাকলেও, তাকে বাদ নিয়ে নিজেই বিয়ে করে।

যে কারণে অনেক সুদানিজ যুবক বিয়ে ছাড়া আর বউহীন থাকে। এর ফলে মাঝেমধ্যেই নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়। একেকজন পুরুষ চারটা বউ একসাথে রাখতে পারে। চার বউওয়ালা একজন শপিংমল মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছিলো আমার। তার সর্বমোট বাচ্চার সংখ্যা ১৭ জন!

সুদানে প্রচুর গরম কিন্তু ঘাম নাই। এক জামাকাপড়ে দিব্যি দিনের পর দিন থাকা যায়! সূর্য উদয় থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সমান গরম। কিন্তু অবাক করা বিষয়- গাছের ছায়ায় বা ছায়ায় তাপমাত্রা খুব স্বাভাবিক ও আরামদায়ক। ছোটবড় অগণিত পাথুরে পাহাড় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফসলি জমিতে সুদানিজরা কাজ করে রোদের মধ্যে। আশপাশে ঝাঁকড়া একটা দুইটা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। নারীরা ওই রোদে ক্ষেতে কাজ করে, আর পুরুষরা গাছের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে বা টুলে বসে গল্পগুজব করে বা তাস খেলে, চায়ের দোকানে আড্ডা মারে!

এখানকার পুরুষরা বাচ্চা উৎপাদন ছাড়া সংসারের আর কোনো কাজেই আসে না সচরাচর। নারীরা সংসারের সব কাজ করার পাশাপাশি রান্নার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ, পানি সংগ্রহ, ব্যবসা সব করে। অধিকাংশ চা বিক্রেতারাই নারী। রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বসে তৈরি হয় এই চা বা কফি। বসার জন্য ছোট প্লাস্টিকের টুল, লোহার টুল বা নাইলনের রশি দিয়ে তৈরি মোড়া রয়েছে চায়ের দোকানে।

সুদানে তেলের চেয়ে পানির দাম বেশি। গোস্তের দাম বেশ সস্তাই। গরুর গোস্ত কেজি প্রতি টাকায় ১৫০-১৬০। বেশ বড় সাইজের মুরগী পাওয়া যায় সুদানে। মুরগীগুলো রান্না করতে গেলে বয়সের ধারণা পাওয়া যায়, ব্রিটিশ আমলে জন্ম নেওয়া যেন একেকটা মুরগী। অনেক হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়েই তবেই গোস্ত সেদ্ধ করা হয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.