172704

হিজাব আমাদের সংস্কৃতি ছিল না কখনই

ফারহানা আনন্দময়ী: ১৯৭১ সালে যাঁরা সময়কে মনে রাখার বয়সে ছিলেন, তাঁরা একটু মনে ক’রে বলুন তো তখন কি কোনো একজন বাংলাদেশি নারীকেও হিজাব পরিহিত দেখেছেন কিনা। আমি বই-ম্যাগাজিনের ছবিতে সেই সময়ের নারীদেরকে যেমন দেখেছি, মনে পড়ে না একজন কাউকেও হিজাবে দেখেছি।  ১৯৭১ গেল… ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১, ২০১১… এরকমই চলছিল।

এই চল্লিশ বছরে বাঙালি নারী তথা আমাদের নানী-দাদি, মা-চাচী, খালা-ফুফু মোটামুটি পরিচিত এবং আশেপাশের সকলকেই শাড়িতে এবং কারো কারোকে শাড়ির আঁচল তুলে মাথায় দিতে দেখেছি। কেউ কেউ সেলোয়ার-কামিজ পরতেন। আমাদের চোখ সেভাবেই অভ্যস্ত হয়েছে। এগুলোই ছিল আমাদের চোখে বাঙালি নারীর মার্জিত পোশাক। হাতে গোণা কিছু নারীকে দেখেছি বোরকা পরতে। সামাজিক অনুষ্ঠানে, অফিসে, রাস্তায়, মার্কেটে তাঁদেরকে আলাদাভাবে চোখে পড়তো, সংখ্যায় গৌণ।
আর আজ ঠিক সেইসমস্ত জায়গাগুলোতে হিজাবের ভীড়ে আমরা সাধারণ পোশাকের নারীরা আলাদাভাবে গণনার মধ্যে পড়ি… নিজেকে এলিয়েন মনে হয়।
গতকাল দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে পড়লাম, ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে “হিজাবিস্তা-ফ্যাশানিস্তা” নামে একটি নারী সংগঠন এক প্রীতি-সম্মিলন করেছে। যেখানে বিভিন্ন পেশার এবং নেশার নারীরা একত্রিত হয়ে নিজেদের ভাবনা ভাগাভাগি করেছেন। ভাবনার বিষয়টিও রিপোর্টে উল্লেখ আছে… ফ্যাশন, শপিং, মেইক-আপ রিভিউজ, হিজাব টিউটরিয়াল, কুকিং। এছাড়া তারা মাঝে মাঝে সামাজিক সেবাও করেন যেমন সমাজের কম-সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্যে ফান্ড তোলেন।
একটি বিজাতীয় পোশাক যখন হালফ্যাশনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে তখন তা নিয়ে বিরুদ্ধাচারণ করাটা বোকামি। কিন্তু সেই ফ্যাশন যখন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে উলটো স্রোতে বইয়ে দেয়ার উপক্রম করে তখন সেটা রুখে দেয়ার প্রয়োজন হয় বৈকি, কথা তখন বলতেই হয়।


আমার যতদূর ধারণা, এই হিজাবের সঙ্গে ধর্মীয় আচার-পালনের যোগসূত্র খুব কম। ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে তারা যদি পর্দা করতো তবে আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে শুধু চোখ দুটো প্রকাশ্য রাখতো। কিন্তু আমরা দেখি এক অদ্ভুতুরে মাথা-প্যাঁচানো পোশাক। গ্রামে যারা হিজাব পরছেন তারা পাশেরজনেরটা দেখে হুজুগে পরছেন। কেউ স্বামীর ধমকে পরছেন, কেউ ওয়াজ-ফতোয়ার ভয়ে পরছেন।
আর শহরে যারা পরছেন, তাদের ৯০% ভাগই ফ্যাশনের জন্যে পরছেন। পোশাকের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ২৫-৩০টা হিজাব আলমারিতে সাজাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও শুনেছি কেউ কেউ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বিউটি পার্লারে গিয়ে শাড়ি পরতেন। এখন নারীরা দেখছি পার্লারে যায় হিজাব সুন্দর ক’রে পরার জন্যে। মাথার হিজাবের ভাঁজ যত বেশি, তত বেশি সৌন্দর্য(!)। চুল-সেট করার খরচ এখন হিজাব-সেটিং’এ খরচ হচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, শুধু মধ্যবয়সী নারীরা নয়, বাঙালি কিশোরী-তরুণীরা হিজাব-স্রোতে ভেসে চলেছে। হাতের মোবাইল সেটের মতো মাথার হিজাবের প্রকরণও তাদের স্ট্যাটাস-সিম্বল হয়ে উঠছে, কার হিজাবে কত বেশি এবং কত দামি পাথর লাগানো আছে! এখনও চোখে পড়েনি, তবে আমি নিশ্চিত, দু’দিন পরে ডায়মন্ডের হিজাব-পিন তাদের মাথায় দেখতে পাবো।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে এবং পোশাকে স্মার্ট এমন ক’জন কিশোরীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এই হিজাব পড়ছো? দেখে তো মনে হয় না, তোমরা খুব রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। তাদের উত্তরটা মোটামুটি এরকম, “ না না, ওরকম কিছু নয়, I just want a changed look.”
এরপরে আর কী বলার থাকে, বলুন। আমি স্বীকার করি, হিজাব পরাটা যে কারোর ব্যক্তিগত পছন্দ। কিন্তু পাঁচ বছর আগেও তো বাঙালি নারীর পছন্দের পোশাকের তালিকায় এই বিজাতীয় হিজাব ছিল না। আজ কেন এলো, কোথা থেকে এসে চেপে বসলো বাঙালি সংস্কৃতির ঘাড়ের ওপরে ? কবে থেকে বাঙালি নারীর সব লজ্জা মাথার চুলে গিয়ে ঠেকলো ? এটা সত্যিই ভাববার বিষয়।
বিষয়টা যদি এমন হতো যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নারীর ব্যক্তিগত পছন্দের পোশাক এই হিজাব তবে এটা ভাববার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ই নয়। কিন্তু ‘শষ্যের চেয়ে টুপির সংখ্যা বেশি’র মতো যখন চারপাশ ছেয়ে যায় হিজাব-সজ্জায় তখন তা আগামিদিনের এক মৌলবাদী বাংলাদেশের ভয়াবহ চিত্রের ইঙ্গিত দেয়। তারা কি একবারের জন্যেও ভাবছেন, এই হুজুগের স্রোতে নাম লেখাতে গিয়ে কী ভয়ংকর এক বাংলাদেশকে তারা আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ?
শুধু কি দেশে? না, ছবিতে দেখেছি বিদেশে বাংলাদেশের কিছু দূতাবাসের বিশেষদিনের আয়োজনে আয়োজকপক্ষকে হিজাবে সজ্জিত। তারা এই সাজে বিদেশিদের কাছে ভুল বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
কারণ, হিজাব-সংস্কৃতি আমাদের নয়, কোন বাঙালির নয়, কোন বাংলাদেশির নয়… কখনোই নয়, কোনোদিন ছিল-ও না। ওইম্যান চাপ্টার

পাঠকের মতামত

Comments are closed.