266065

শরীরে করোনা আছে, উপসর্গ ছাড়াই ভাইরাস ছড়াচ্ছেন যারা

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব তথ্য তাদের চিন্তায়ও ফেলে দিয়েছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শরীরে জ্বর, কাশি, স্বাদ গন্ধের অনুভূতি না থাকার উপসর্গ সম্পর্কে জানা ছিল। কিন্তু কিছু লোকের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের শরীরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। উপসর্গ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগী নীরবে ঘাতক ভাইরাসটিকে অন্যদের মাঝে ছড়াচ্ছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, উপসর্গ ছাড়া কত লোক ভাইরাসটি ছড়াচ্ছেন বা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে উপসর্গ ছাড়া করোনা আক্রান্তদের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে তা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।

কী ঘটেছিল সিঙ্গাপুরের সেই গির্জাটিতে?

চলতি বছরের জানুয়ারির ১৯ তারিখ সকালে সিঙ্গাপুরের দ্য লাইফ চার্চ এ্যান্ড মিশন নামের গির্জাটিতে প্রার্থনায় জড়ো হন অনেক লোক। প্রার্থনায় উপস্থিত কেউই কল্পনা করেননি যে গির্জায় থাকা এক বয়স্ক দম্পতি করোনাভাইরাস ছড়াবে।

ওই গির্জায় প্রার্থনার আগে চীনে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের কথা অনেকেই জানতেন। তবে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে ঘনঘন কাশি হয় বলে সবার ধারণা ছিল।

প্রার্থনায় অংশ নেয়া ৫৬ বয়সের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার কারো কাশি ছিল না। এমনকি ছিল না করোনার উপসর্গ বা স্বাস্থ্য সমস্যাও। ফলে গির্জার কেউ করোনাভাইরাস নিয়ে ভাববার কোনো কারণ ছিল না।

কিন্তু জানা গেল, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু চীনের উহান শহর থেকে সকালেই প্রার্থনায় অংশগ্রহণের জন্য গির্জায় হাজির হন ওই দম্পতি। প্রার্থনা শেষে তারা সঙ্গে সঙ্গে গির্জাও ছাড়েন।

জানুয়ারির ২২ তারিখ প্রথমে ওই বয়স্ক নারী অসুস্থ হন। দুইদিন পর তার স্বামীও অসুস্থ হয়েছিলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে সিঙ্গাপুরে তৃতীয় লোকের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তাদের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সংক্রমণের পথ খোঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ।

ওই গির্জা থেকেই সিঙ্গাপুরে করেনাভাইরাস বিস্তার শুরু

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ভারনন লী বলেন, আমরা একেবারেই বোকা বনে গিয়েছিলাম। যাদের দেহে রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তারা কী করে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে?

কোভিড-১৯ সম্পর্কে জানা তথ্য অনুযায়ী কী করে লোকের মধ্যে রোগটা ছড়াচ্ছে তা বুঝতে পারছিলেন না তারা। তখন পুলিশ এবং রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা তদন্ত শুরু করলেন ড. লী। কে কখন কবে কোথায় ছিলেন তার একটি মানচিত্র তৈরি করলেন তিনি।
এটাকে বলে কনট্যাক্ট ট্রেসিং। যার মাধ্যমে সংক্রমণের পথ জানা যায় ও রোগ বিস্তার রোধ করা যায়।

বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন সিঙ্গাপুরের তদন্তকারীরা কয়েকদিনের মধ্যে সেই গির্জার ১৯১ জন লোকের সঙ্গে কথা বলেন। তারা ১৪২ জনকে সেই প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন বলে শনাক্ত করেন। এটাও জানা গেল যে ওই প্রার্থনায় চীনা দম্পতি ছিলেন।

ড. লী বলেন, গির্জায় প্রার্থনার সময় হয়তো তারা কথা বলেছিলেন বা পরস্পরকে সম্ভাষণ করেছিলেন, যা গির্জায় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
তবে চীনা দম্পতির শরীরে সংক্রমণের কোনো লক্ষণ ছিল না। এতে ভাইরাস ছড়ানোর প্রশ্ন জেগে উঠে। এদিকে সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত তৃতীয় ব্যক্তি প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন না। তাহলে কিভাবে তৃতীয় সংক্রমিত নারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন।

অপ্রত্যাশিত তথ্যপ্রমাণ মিললো সিসিটিভিত

ভাইরাস ছড়ানোর জবাব খুঁজতে গির্জার সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করতে শুরু করলেন তদন্তকারীরা। এতে গির্জা থেকে চলে যাবার পর একটি চেয়ারে বসেছিলেন চীনা দম্পতি। কয়েক ঘণ্টা পর সেই চেয়ারেই তৃতীয় সংক্রমিত নারী বসেছিলেন।

চীনা দম্পতির শরীরে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ ছিল না। তবুও না জেনেই তারা ভাইরাসটি ছড়াচ্ছিলেন। তবে কিভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল তা পরিষ্কার নয়। এটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত করতে উপসর্গ চিহ্নিত করার দিকে নজর দেয়া লাগত।

এখন জানা গেল, কোন উপসর্গ ছাড়াই নীরবে-অদৃশ্যভাবে করোনাভাইরাসটি ছড়াতে পারে। ড. লীর এ উপলব্ধির মুহূর্তটির কথা পরিষ্কার মনে আছে।

উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই রোগ বিস্তার ঘটে যাচ্ছে। একে বলে প্রি-সিম্পটম্যাটিক ট্রান্সমিশন। যখন কারো শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের লক্ষণ – যেমন জ্বর, কাশি দেখা দেবার আগেই অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়াতে শুরু করে।

এই জরিপে দেখা যায়, করোনাভাইরাস কারো শরীরে ঢোকার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত কোন লক্ষণ দেখা যায় না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি অত্যন্ত সংক্রামক হতে পারেন ।

উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে সতর্ক করা যায়। আইসোলেশনে পাঠানো যায়। কিন্তু ঠিক কিভাবে করোনাভাইরাস ছড়ায় তা এখনো স্পষ্ট নয়।

সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তি কাশির সময় নাক-মুখ দিয়ে আসা ড্রপলেটস্ বা অতি ক্ষুদ্র পানির কণা বেরিয়ে আসে। এর মধ্যেই থাকে ভাইরাস। তবে উপসর্গ ছাড়া ভাইরাস ছড়ানোর ব্যাপারে কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলছেন, কথা বলার সময় বা শ্বাস-প্রশ্বানের মাধ্যমেও ড্রপলেটস্ বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ এ সময়টা শ্বাসনালীর ওপরের অংশেই ভাইরাসগুলো অবস্থান করে। প্রতিবার নিঃশ্বাস ফেলার সময়ই এগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। কাজেই কাছাকাছি বা বিশেষত ঘরের ভেতরে কেউ থাকলে খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।

সংক্রমণের আরেকটা বড় উপায় হলো স্পর্শ। কারো হাতে ভাইরাস লাগলে তিনি যদি আরেকজনের হাত, দরজার হাতল, টেবিল-চেয়ার বা অন্য কিছু স্পর্শ করেন তবে তার মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।

সন্দেহভাজন রোগীকে পরীক্ষা করা হচ্ছে

সন্দেহভাজন রোগীকে পরীক্ষা করা হচ্ছে

কিছু লোকের শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ হলেও উপসর্গ না প্রকাশ পাওয়ায় কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারছেন না। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ মেরি ম্যালন নামে গত শতাব্দীর এক আইরিশ নারী।

মেরি ম্যালন নিউ ইয়র্ক শহরের একাধিক বাড়িতে রাঁধুনী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি টাইফয়েডের জীবাণু বহন করছিলেন। কিন্তু তার নিজের শরীরে কোনো উপসর্গ ছিল না। তার মাধ্যমে নিউইয়র্কের বাড়িতে বাড়িতে টাইফয়েড সংক্রমিত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। পরে ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে প্রায় ২৩ বছর আটক রেখেছিল নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ।

ব্রিটেনের কেম্ব্রিজের এ্যাডেনব্রুক হাসপাতালের একজন নার্স এ্যামেলিয়া পাওয়েলের শরীরে ভাইরাস থাকলেও সেটির কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায়নি।

এ্যামেলিয়া পাওয়েল বলেন, আমি হাসপাতালের রোগীদের দেখে চিন্তিত হতাম যে, কোনো দিন আমারও এটা হতে পারে কিনা। কিন্তু আমি নিজে কোন কিছুই অনুভব করিনি, আমি স্বাভাকিভাবেই খাওয়া দাওয়া, ঘুম, ব্যায়াম করছিলাম।

ঘটনাচক্রে হাসপাতালের স্টাফদের এক জরিপে অংশ নেয়ায় করোনাভাইরাস টেস্ট করাতে হয়। সেই টেস্টে করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়লে কাজ ছেড়ে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে হয়। ওই জরিপে অংশ নেয়া ভাইরাস আক্রান্তদের মাঝে তিন শতাংশ লোকের শরীরে ভাইরাসের কোনো উপসর্গ ছিল না।

এ রকম লোকের সংখ্যা কত?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ সংক্রান্ত ২১টি গবেষণা প্রকল্পের উপাত্ত পরীক্ষা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল হেনেগ্যান।
তিনি বলছেন, উপসর্গবিহীন কোভিড-১৯ ভাইরাস বহনকারীর অনুপাত পাঁচ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর সংখ্যা নির্ণয় করার মতো নির্ভরযোগ্য জরিপ একটিও নেই।

উপগর্স ছাড়া করোনা আক্রান্তরা কত বড় ঝুঁকি?

এ্যামিলিয়া হয়তো না জেনেই সহকর্মী ও রোগীদের মাঝে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছেন। কতদিন থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন তাও জানতেন না তিনি।

চীনের একটি জরিপ অনুযায়ী, উপসর্গবিহীনদের সংখ্যা আসলে বেশিই দেখা গেছে। যা সংক্রমণ রোধ বা নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দাবি করে।

ব্রিটেনের আর্লহ্যাম ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান অধ্যাপক নিল হলের মতে, উপসর্গবিহীন কোভড বহনকারীরা হচ্ছেন এই মহামারির ‘ডার্ক ম্যাটার। তিনি বলেন, হয়তো তারাই এ মহামারি জিইয়ে রেখেছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, মহামারির ব্যবস্থাপনার ওপর এ ধরণের উপসর্গবিহীন সংক্রমণের ঝুঁকি এক গভীর প্রভাব ফেলছে।
দেশে দেশে লকডাউন শিথিল হচ্ছে। লোকজন চলাফেরা করছে। এ অদৃশ্য ঝুঁকির মোকাবিলা করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এদিকে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ও তা না পারলে মাস্ক ব্যবহারের মাধ্যমেই করোনা প্রতিরক্ষা করাই সর্বোত্তম পন্থা। ভাইরাসটিকে হয়তো পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব না। তবে যা জেনেছি তা দিয়েই চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?

-বিবিসি বাংলা

পাঠকের মতামত

Comments are closed.