272014

নিজের রূপে মুগ্ধ করে প্রেমিকদের অন্ধকার গুহায় আটকে রাখতেন বনদেবী

একাধিক মুখ ভারতীয় পুরাণে দেবতাদের এটা নতুন কিছু নয়। চতুরানন ব্রহ্মা বা পঞ্চানন মহাদেবের কথা আমরা সকলেই জানি। গীতায় শ্রীবিষ্ণুর যে পরম রূপের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে তারও অজস্র মুখের কথা জানা যায়। দেব-দানব থেকে মানুষ পশুপাখি সবই না কি মিলিয়ে যায় সেই সহস্র মুখের অন্ধকারে! অসংখ্য মুখ না হলেও, রোমান দেবতা জানুস বা ইয়ানুসেরও ছিল দু’দুটি মুখ।
এহেন জানুস বা ইয়ানুসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রোম পুরাণের বহু উপকথা। রোমানরা বিশ্বাস করতেন রোমের সৃষ্টির সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন এই আদিদেব। দেবী কার্ডিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের গল্পও রোমান উপকথাগুলোতে বেশ জনপ্রিয়।

রোমান পুরাণ অনুসারে বনদেবী ক্রেন বা কার্ডিয়া ছিলেন যেমন রূপসী, তেমনই ছলনাময়ী। তার রূপে মুগ্ধ প্রেমিকদের আকর্ষণ করে জঙ্গলের পথে নিয়ে যেতেন এই দেবী। আশার ছলনে ভুলি সেই সুন্দরীর পিছনে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সেই প্রেমে অন্ধ যুবকেরা আটকে পড়তেন এক অন্ধকার গুহায়। ছলনায় তাদের গুহার মধ্যে বন্দী করে প্রবেশপথ বন্ধ করে দিতেন দেবী কার্ডিয়া।

এটাই ছিল তার রোজকার খেলা। দেবতা জানুসের সঙ্গেও এই একই ছলনা করার চেষ্টা চালান দেবী কার্ডিয়া। বনদেবীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও জানুসের মাথার দুদিকেই যে রয়েছে দু’জোড়া করে চোখ! তার সঙ্গে চাতুরি করে পারবেন কেন বনদেবী। পেছন দিকের চোখ দিয়ে সবটাই দেখে ফেলেন জেনুস। আর প্রেমিককে গুহাবন্দি করে পালানোর আগেই তার হাতে বন্দি হন ছলনাময়ী কার্ডিয়া।

দেবতা জানুসের প্রেমিকা রূপেই রোমান পুরাণে কার্ডিয়ার প্রসিদ্ধি। কার্ডিয়া নামটা এসেছে লাতিন শব্দ ‘কার্ডো’ থেকে, যার অর্থ ‘কব্জা বা ছিটকিনি’। পরবর্তীতে দেবী কার্ডিয়া সত্যিই হয়ে ওঠেন কাব্জার অধীশ্বরী। রোমান উপকথা অনুসারে প্রতিটি পরিবার আর শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব দেবী কর্ডিয়ার। তিনিই মন্দ আত্মাকে দরজার চৌকাঠ পার হতে দেন না, রক্ষা করেন মানুষের শুভবোধ।

১৯ শতকের আঞ্চলিক গল্পগাথাসহ বহু বহু রোমান উপকথায় দেবতা জানুস ও তার প্রেমিকা কার্ডিয়ার কাহিনি ছড়িয়েছিটিয়ে থাকলেও জানুসের স্ত্রী ছিলেন না কার্ডিয়া। রোমান পুরাণে জানুসের তিন স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন ক্যামেস, জানা আর ইয়ুতুর্না। তাদের মধ্যে ক্যামেস ছিলেন জানুসের বোন এবং একইসঙ্গে তার প্রথম স্ত্রী। টাইবেরিনাস আর ফন্টাস নামে দুই সন্তানও ছিল জানুসের। টাইবেরিনাস ছিলেন ক্যামেসের পুত্র, যে নদীতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ দিয়েছিল কালক্রমে সেই নদীরই নাম হয়ে যায় টাইবার।

ইতালির প্রাচীন শহর ‘অ্যালবা লংগার রাজা নিউমিটরের মেয়ে ছিলেন পরম রূপসী রাজকন্যা রিয়া সিলভিয়া। রোমান দেবতা মার্স ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিমান যোদ্ধা। রোমান যুদ্ধ-বিগ্রহের দেবতাও ছিলেন তিনি। মার্সের প্রেমে পড়েন রাজকন্যা রিয়া সিলভিয়া।

রোমিউলাস ও রেমাস নামে তাদের দুই যমজ ছেলে জন্মায়। তবে তাদের জন্মের সময়ই দৈববাণী হয় যে এই দুই ভাই এক রাজার মৃত্যুর কারণ হবে। নিউমিটরের ভাই আমুলিউস দাদাকে সরিয়ে সিংহাসন দখলের চেষ্টায় ছিলেন। এই দৈববাণী শুনে তিনি ভয় পেয়ে যান। নিজের পথের কাঁটা দূর করতে তিনি চাকরদের আদেশ দেন সদ্যোজাত রোমিউলাস আর রেমাসকে কেটে দু’টুকরো করে টাইবার নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে।

তবে অত ছোটো অসহায় দুটো বাচ্চাকে কাটতে গিয়ে হাত কেঁপে যায় রাজভৃত্যদের। প্রাণে ধরে মেরে ফেলতে না পেরে তারা টাইবার নদীর কিনারে ফেলে আসে দুই দুধের শিশুকে। এক মাদি নেকড়ে সেসময় জল খেতে গেছিল নদীতে। বাচ্চাদের কান্না শুনে খুঁজতে খুঁজতে নদীর ধারে ঝোপের মধ্যে দুই সদ্যোজাতকে খুঁজে পান।

সেখান থেকে তাদের নিয়ে যায় নিজের গুহায় আর সন্তানস্নেহে মানুষ করতে থাকে। সভ্যতা থেকে দূরে লুপারকাল নামের একটা গুহায় নেকড়ে মায়ের আদরে বড় হতে থাকে দেবতার সন্তান রোমিউলাস আর রেমাস। শেষমেশ দৈববাণীর কথাই ফলে যায়। বড় হয়ে রেমিউলার আর রেমাস দুই ভাই উৎখাত করে অত্যাচারী শাসন আমুলিউসকে। নতুন এক নগরসভ্যতা তৈরি করতে চায় দুই ভাই।

আর তাই নিয়েই বাধে ঝগড়া-অশান্তি। মনোমালিন্য বাড়তে বাড়তে হাতাহাতির চেহারা নেয়। মারামারির এক পর্যায়ে এসে রোমিউলাস হত্যা করে নিজেরই যমজ ভাই রেমাসকে আর গোড়াপত্তন করেন আধুনিক রোমের। এই রোমিউলাসের নির্দেশে যখন তার সঙ্গীসাথিরা স্যাবিন গোষ্ঠীর এক অসহায় নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় তখন ক্রুদ্ধ জানুস এক আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করেন।

গরম আগুনের লাভায় ডুবিয়ে মারেন অপরাধীদের। রোমের দ্বিতীয় সম্রাট নুমা ছিলেন এই স্যাবিন গোষ্ঠীর লোক। তিনি বেশ ধর্মপ্রাণ ছিলেন বলেও জানা যায়। যেখানে জানুসের রাগে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি জন্মেছিলে, পুরাণবর্ণিত সেই এলাকায় তিনি একটি সুবিশাল মন্দির তৈরি করেন এবং দেবতা জানুসকে উৎসর্গ করেন। মন্দিরের দুপাশে ছিল দুটো দরজা, মাঝখানে বসানো ছিল দেবতা জানুসের বিশাল এক ব্রোঞ্জ-মূর্তি।

তার দুই মুখ দুদিকের দরজার দিকে ফেরানো। এই মন্দিরের একটা মজা ছিল। প্রাচীন রোমে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল রোজকার ঘটনা। ছোটো ছোটো রাজ্যগুলোর মধ্যে মারামারি লেগেই থাকত। শান্তি জিনিসটাই ছিল প্রায় আকাশকুসুম। যুদ্ধ চলাকালীন জেনুসের মন্দিরের ওই দরজাদুটো খুলে দেয়া হত হাট করে। আর যুদ্ধ বন্ধ হলে বন্ধ হত দরজাও ।

প্রাচীন রোমের অনেক মুদ্রাতেই জানুসের ওই মন্দিরের বন্ধ দরজার প্রতিচ্ছবি খোদাই করা আছে। মনে করা হয়, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজমান, এটা বঝাতেই রাজারা এই বিশেষ ধরণের জানুস-মুদ্রা চালু করতেন বাজারে। এছাড়া জানুসের মুখের ছবি সম্ভলিত বহু পুরোনো মুদ্রা পাওয়া যায়, প্রাচীন রোমে তার কতখানি প্রতিপত্তি ছিল তারই প্রমাণ দেয় এই মুদ্রাগুলো।

হিন্দু পুরাণের দেবতা গণেশের সঙ্গে রোমান দেবতা জানুসের মিল চোখে পড়ার মতো। ভারতীয় পুরাণ অনুসারে পার্বতীপুত্র গণেশ হলেন বিঘ্ননাশকারী, সিদ্ধিদাতা। তাই যেকোনো কাজ শুরু করার আগে, বা যেকোনো দেবতার পুজোর আগে গণেশের পুজো করতে হয়। গণেশকে তুষ্ট না করলে কার্যসিদ্ধি অসম্ভব।

রোমান পুরাণেও বলা হয়েছে যেকোনো দেবতার আরাধনার পূর্বে দেব জানুসের আরাধনা করার কথা। জানুসকে তুষ্ট না করে স্বর্গের পথে পা বাড়ানো অসম্ভব। তিনিও গণেশের মতোই মানুষের বিঘ্ন বিপদ নাশ করেন। গণেশের মতোই জানুসও বুদ্ধিমান, কিন্তু কূট নন। তার হাতের বিশাল চাবিটি তার বাণিজ্যযোগেরও প্রমাণ দেয়। আর কে না জানে আমাদের গণপতি বাপ্পাও ব্যবসায়ীদের প্রধান আরাধ্য দেবতা।

সব মিলিয়ে আশ্চর্য এই মিল। দেবতা জানুস আর তাকে ঘিরে গুঞ্জরিত হওয়া উপকথাগুলোও কিছু কম আশ্চর্যের নয়। মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ কোনো কিছুই জানুসের নাগালের বাইরে নয়। বছরের প্রথম মাসের নামের সঙ্গে আজও জড়িয়ে আছে রোমান এই আদিদেবের নাম।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.