270752

২০০ বছর আগে বাংলায় গড়ে ওঠে হুঁকোর কারখানা

আধুনিক যুগের বিভিন্ন ধরনের হুঁকো

গ্রাম্য জীবনে হুঁকোর চল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা প্রচার করেন, তামাক আবিষ্কৃত হয়েছিল আমেরিকায়। নৃতত্ব কিন্তু সে দাবি সমর্থন করে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রাচীন সেমা নাগা উপজাতীয়রা যে দেশি হুঁকোয় তামাক খান তার নাম ‘তসুনকুবা’। তিন টুকরো বাঁশ দিয়ে তৈরি ধূমপানের এই যন্ত্রের মধ্যমণি বাঁশের চোঙ বা খোল। এর ভেতর থাকে পানি। এর সঙ্গে লাগানো থাকে একটা নল আর ওপরের তামাকপাত্র।

পর্তুগিজরা ভারতে জাহাজ ভেড়াবার কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ধূমপানের অভ্যাস চালু ছিল। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ধূমপানের উপকারিতা সম্পর্কে চরক বলেছেন,  ‘স্নাত্বা ভুক্তা সমুল্লিখ্য ক্ষুত্বা দন্তান বিঘৃষ্য চ। নাবনাঞ্জুন নিদ্রান্তে চাত্মবান ধুমপো ভবেত্।।‘ অর্থাৎ, গোসলের পর, ভোজনের পর, বমি হলে, হাঁচি হলে দাঁত ধুয়ে নস্যি দিয়ে শির বিরেচনান্তে, ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে ধূমপান করবে।

আর হুঁকো সাধারণের ব্যবহার্য। কিন্তু গড়গড়া বা আলবোলা আভিজাত্যের প্রতীক। ইতিহাস বলছে, ভারতে ধনী সমাজে প্রথম গড়গড়ার চল হয় আকবরী আমলে। এর আগেই অবশ্য পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে ধুমপানের এই রীতি। পারস্যে গড়গড়ার নাম ‘গলিয়াঁ’। মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে এর পরিচিতি ‘সীসা’ নামে। একে ‘নারগিলে’ নামে চেনেন তুরস্কের মানুষ।

হুঁকো তৈরি করছেন একজন কারিগর

হুঁকো তৈরি করছেন একজন কারিগর

পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীন কালে ব্যবহৃত নারকেল মালার হুঁকোর চল ছিল এই অঞ্চলেও। সংস্কৃতে নারকেলকে বলা হয় নারিকেল। তার থেকেই পরবর্তীকালে ‘নারগিলে’ নামের উৎপত্তি। মুঘল বাদশা আকবরের দরবারে পারস্যজাত হাকিম আবুল ফথ্ গিলানির সৌজন্যে এর আবির্ভাব। কথিত, এর আগে হিন্দুস্তানের মানুষ ছিলিমের সাহায্যে ধূমপান করতে অভ্যস্ত ছিলেন। মুঘল মন্ত্রী-আমলাদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানের প্রভাব লক্ষ্য করে গিলানি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শেষে জলের মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া চালান করার কৌশল আবিষ্কার করেন হাকিমসাহেব।

নন্-স্মোকার বাদশার মনোরঞ্জনের জন্য পানিভরা পাত্রে তামাকের ধোঁয়া নল দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তা দিয়ে শুদ্ধ ও ঠান্ডা করার কায়দা চালু করেন গিলানি। পানির মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া চলাচলের সময় যে শব্দ তৈরি হয়, তা থেকেই এর নাম হয় ‘আলবোলা’, ‘গুড়গুড়া’ বা গড়গড়া। ক্রমে ভারতীয় সমাজে তার কদর বাড়ে। বিশ্বে হুঁকো বা হুক্কার নাম ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কলকাতায় পা দেয়া ইংরেজ কেরানিদের অবসর যাপনের অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে এই ধোঁয়াযন্ত্র। ১৭৭৫ সালে শহরে পা রাখার পর হুঁকোর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় উইলিয়াম হিকির। তার লেখায় হুঁকোর উল্লেখ পাওয়া যায়। হিকি লিখেছিলেন, আমার জন্য উঁচু মানের একটি সুন্দর হুক্কা সাজানো হল। কিন্তু চেষ্টা করেও তার স্বাদের তারিফ করতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে জানতে চাইলাম, এটা না খেলেই কি নয়? গম্ভীর ভাবে পারিষদ জানালেন, উপায় নেই। সমাজে কেতাদূরস্ত হতে গেলে ধূমপান আবশ্যিক। এখানে প্রায় সকলেই হুক্কা ব্যবহার করে। অনেকেরই মত, নৈশাহার না জুটলে পরোয়া নেই, কিন্তু তারপর ধূমপানের বন্দোবস্ত না থাকলে সবই মাটি।

বাঁশের হুঁকো

বাঁশের হুঁকো

কোম্পানির আমলে চাকর-বাকরের বহর ছিল দেখার মতো। সেকালে হুঁকোর দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তাত হুঁকোবরদারের ওপর। দুপুরবেলা খাওয়া সেরে গড়গড়ায় টান দিতে দিতে বিশ্রাম নিতেন সাগরপারের যুবক কেরানি বা রাইটার। এদিকে সাহেবের লাঞ্চ শেষ হওয়ার আগেই গড়গড়ায় তামাক সাজতে বসত নফর। আর সে তামাক সাজাও ছিল এক এলাহি কাণ্ড। গোড়ার দিকে গড়গড়ার মুখে আগুন জ্বালাতে ব্যবহৃত  হত কাঠকয়লা। ১৮৭২ থেকে ১৮৭৩ সাল নাগাদ মানিকতলার মুসলমান কারিগররা কাঠকয়লার গুঁড়োর সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে বাজারে ‘টিকে’র প্রচলন করেন। স্থানীয়রা তার নাম দিলেন “কালো বাতাসা”।

শুরুতে হিন্দুরা জাত হারানোর ভয়ে না ছুঁলেও ক্রমেই সমাজে তার ব্যমবহার বাড়তে থাকে। শেষে কট্টর হিন্দু বাবুদের বৈঠকখানাতেও আলবোলায় অগ্নি সংযোগ করতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে টিকে। ততদিনে অবশ্য দস্তুরমতো শৌখিন হয়ে উঠেছে ধূমপানের আয়োজন। জমিদার প্রথার উতপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সাবেক হুঁকোর জায়গা দখল করে বনেদি গড়গড়া। নারকেলের মালার বদলে ব্যবহার হতে শুরু করে কাচ বা পিতলের জলদানি। ধনীরা অবশ্য রূপোর পাত্রে গোলাপজলে শোধিত তামাকের ধোঁয়া সোনার নল দিয়ে টানতেন। বাবু সমাজে ফরাস, ঝাড়বাতি, আতরের সঙ্গেই অনায়াস সহাবস্থান ছিল গড়গড়ার।

সত্যজিত রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিতে গড়গড়ায় টান দিতে দেখা গিয়েছিল জমিদার রূপী ছবি বিশ্বাসকে। ‘সন্যাসী রাজা’ ছবির গানের দৃশ্যেও রাজার ভূমিকায় উত্তমকুমারের বৈঠকখানায় দেখা গিয়েছে আলবোলা। গ্রাম্য কৃষক বা হাটুরে কাজের ফাঁকে বা পথচলার মাঝে বিশ্রাম নিতে যে হুঁকো ব্যবহার করেন, তার তামাক স্বাভাবিক ভাবেই নিম্ন মানের। দামও কম।

নারকেলের মালার তৈরি হুঁকো

নারকেলের মালার তৈরি হুঁকো

কিন্তু বিত্তবানের গড়গড়া সাজতে প্রয়োজন হয় খানদানি তামাকের। মল্লিকবাজারের দুটি দোকান ছাড়া কলকাতায় মিঠে তামাকের আদি মজুতদার জাকারিয়া স্ট্রিটের গোটা তিনেক প্রাচীন দোকান। ১৮৯৬ সালে স্থাপিত লোদি পরিবারের দোকানের বর্তমান মালিক মহম্মদ রিয়াস লোদি। তিন পুরুষ আগে ওঁর প্রপিতামহ দোকানের পত্তন করেন। প্রধানত দু ধরনের তামাকের চলন রয়েছে এদেশের বাজারে। ‘অম্বরী’ বা ‘অম্বুরী’ তামাকের দাম সবচেয়ে বেশি।

আদিকালে মিশর-পারস্য-তুরস্কের শৌখিন রইসদের পছন্দ এই তামাক সুবাসিত করতে ব্যবহার করা হত এক জাতের তিমির পেটে জমা হওয়া প্রাকৃতিক সুগন্ধী। সে দিন ফুরিয়েছে বহুকাল আগেই। এখন অম্বুরী তামাকে গন্ধ আনতে দামী আতর বা মশলা ব্যবহার করাই প্রথা। জনপ্রিয় সুগন্ধির মধ্যে রয়েছে ৪টি- শমামা, কেওড়া, হেনা এবং কস্তুরী। অম্বুরী তামাকের দাম প্রতি তোলায় ১ হাজার টাকা থেকে শুরু। লোদি সাহেব জানালেন, মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে এর চাহিদা বেশি। অম্বুরীর চেয়ে তুলনায় দাম কম ‘বালাখানা’ তামাকের। এর সুগন্ধ তৈরি হয় লবঙ্গ, এলাচ, জাফরান বা নানারকম ফলের সাহায্যে।

সস্তার বালাখানা মিলবে তোলাপ্রতি ৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। তবে সুপারফাইন বালাখানার দামও ২ হাজার টাকা তোলা। কলকাতার তোপসিয়া অঞ্চল এবং হাওড়ায় তামাকের আড়ত। গড়গড়ায় ব্যবহার্য তামাককে ওরা বলেন “খামিরা তাম্বাকু”। কলা, আম, বেল, টোপাকুল অথবা আনারসের মতো ফলের নরম শাঁসের সঙ্গে জারানো হয় তামাক পাতা। ১৫-৩০ দিন মাটির মালসা বা সিমেন্টের চৌবাচ্চায় পচতে দেয়া হয় সেই মিশ্রণ। এরপর তা শুকিয়ে বাজারে আনা হয়। সাবেক কলকাতায় বনেদি ক্লাবগুলিতে একদা প্রচলন ছিল গড়গড়া সেবনের। এমনকি লাটভবনেও দাপটে রাজত্ব করেছে হুক্কা।

পাহাড়ীদের মধ্যে হুঁকোর ব্যবহার দেখা যায়

পাহাড়ীদের মধ্যে হুঁকোর ব্যবহার দেখা যায়

১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রধান সেনাপতির স্ত্রী লেডি ন্যুজেন্টের লেখনীতে সে বিবরণ পাওয়া যায়। সে যুগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রকাশ্যে ধূমপানের রেওয়াজ চালু ছিল। শৌখিন হুঁকোখোররা অনেকেই তাদের নিজস্ব হুঁকোবরদারদের নিয়ে চলাফেরা করতেন। আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেও সঙ্গে থাকত পেয়ারের তামাক সেজে দেয়ার চাকর। আধুনিক যুগে হুক্কা বারের প্রচলন হয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ছাড়াও বিশ্বের বহু শহরেই।

তবে আধুনিক কলকাতায় এ ব্যাপারে পথিকৃত ‘সীসা হুক্কা বার’। নবীন প্রজন্মের কাছে গড়গড়ায় তামাক সেবনের অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে ২০০৬ সালে এই হুঁকোর ঠেকের আত্মপ্রকাশ। গড়গড়ায় বিভিন্ন ফল-ফুলের গন্ধমাখা, মধু মিশ্রিত তামাক সেবন করার আরও বেশ কিছু আড্ডা পরবর্তী কালে গজিয়ে ওঠে শহরের নানা প্রান্তে। ধীরে-সুস্থে আরাম করে বসে গড়গড়ার নলে মৃদু-মন্দ টান দেওয়াই দস্তুর। রসিকরা বলেন, এতে শরীর ও মন, দুটোই ঠান্ডা হয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.