270756

নগ্ন এক জাতি, ৬০ হাজার বছর ধরে রয়েছে সবার অগোচরে!

পৃথিবীকে চার ভাগে ভাগ করলে এর প্রায় তিন অংশেই পানি পাওয়া যাবে। আর বাকি এক ভাগেরও কম রয়েছে স্থলভাগ। সাগর ও মহাসাগরের আশেপাশে রয়েছে অনেক ছোট বড় দ্বীপ। সেই দ্বীপগুলোতে বাস করে নানা উপজাতির মানুষেরা। এদের কথা আমরা অনেকেই এরই মধ্যে জেনেছি।

বিভিন্ন ডকুমেন্টরি এবং সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে এদের জীবন চিত্র। তবে এখনো অনেক জাতি সম্পর্কে অজানাই থেকে গেছে সবকিছু। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি অন্যতম হলো তাদের অপরাগতা। এসব অজানা জাতি তাদের নিজেদের পরিচয় জানাতে চান না বহির্বিশ্বকে। তেমনি হাজারো বছর ধরে লুকিয়ে থাকা এক জাতিকে নিয়েই আজকের লেখা।

ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি প্রত্যন্ত দ্বীপে বাস করে এক উপজাতিরা। দ্বীপটির নামানুসারেই এদের বলা হয় সেন্টিনেলিজ জাতি বা গোত্র। দ্বীপটির নাম সেন্টিনেল। সেখানেই ৬০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই জাতির বাস। সম্প্রতি এই দ্বীপটির বাসিন্দাদের হাতে আমেরিকা থেকে আসা একজন পর্যটক নিহত হওয়ার পর এই বাসিন্দাদের উপর সবার নজর পড়েছে।

সমুদ্রের পাড়েই তাদের বসতি

সমুদ্রের পাড়েই তাদের বসতি

এই গোত্রের মানুষরা এখনো বিশ্ববাসী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। গত ১৭ই নভেম্বর ২০১৮ সালে জেলেদের নৌকায় করে ওই দ্বীপপুঞ্জের সেন্টিনেল দ্বীপে যান জন অ্যালেন চাউ। তিনি দ্বীপে খ্রিস্ট ধর্মের বার্তা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সেখানকার উপজাতিরা তাকে ভুল বুঝে ধনুক এবং তীরের সাহায্যে হত্যা করে। জেলেরা জানায়, তারা দেখতে পেয়েছেন দ্বীপের আদিবাসী লোকজন সৈকতে একটি মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং কবর দিচ্ছে। এখনো তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি ভারতীয় কর্মকর্তারা। সেন্টিনেল দ্বীপে বসবাসকারী এই আদিবাসী উপজাতি বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।

এখানে নারী পুরুষ উভয়েই উলঙ্গ হয়েই থাকে। তারা জানেও না শরীরে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতে হয়! তবে ঠিক কতজন মানুষ এখানে রয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১১ সালের ভারতীয় আদমশুমারিতে ১২ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। রিপোর্টে প্রাপ্ত ফলাফল হেলিকপ্টার থেকে উপজাতি পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া যায়। অন্যান্য বিষয়ক গবেষণা থেকে অনুমান করা হয় এদের সংখ্যা ১০৫ অথবা ৩৯ থেকে ৪০০ এর মধ্যে। সেন্টিনেলদের এখানে বসবাস প্যালিওলিথিক সময় থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা অনেকের। এদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।

সেন্টিনেন্টাল শিশুরা

সেন্টিনেন্টাল শিশুরা

সেন্টিনেলরা ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর আগে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। এই উপজাতিরা আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়া প্রথম ব্যক্তির বংশধর হতে পারে। পোর্ট ব্লেয়ারে একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দারা হল আসলে পাঠান দণ্ডপ্রাপ্তরা (আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের একটি গোত্র)। যারা ব্রিটিশ কারাগার থেকে পালিয়ে দ্বীপটিতে লুকিয়ে রয়েছে।

সেন্টিনেলরা বিশ্বের অন্যতম বিচ্ছিন্ন উপজাতি। তাদের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ৭০ এর দশক থেকে এই আদিবাসীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেও, সরকারি একটি অভিযানের অংশ হিসাবে ১৯৯১ সালে ওই দ্বীপে গিয়ে উত্তেজনার মুখে পড়েছিলেন টিএন পন্ডিত। তিনি বলেন, এরা খুবই হিংস্র স্বভাবের। তারা তাদের এলাকায় অন্যদের প্রবেশের ব্যাপারে একেবারেই সম্মত নয়। তাই কেউ সেখানে গেলেই তাদের তীর ধনুক দিয়ে আক্রমণ করে।

তাদের সীমানায় যাওয়া মানা

তাদের সীমানায় যাওয়া মানা

টিএন পন্ডিতকে প্রথমে একটি ছোট ছেলে দেখে। সে তাকে ছুরি বের করে সতর্ক করে। ইশারায় বোঝায় তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করলেই গর্দান হারাতে হবে। টিএন সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর আবারো কয়েকবার এই দ্বীপে তিনি গিয়েছেন। সঙ্গে ওই আদিবাসীদের জন্য আমরা হাঁড়িপাতিল, অনেক নারকেল, লোহার তৈরি যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েছিল। পাশের আরেকটি অনজে গোত্রের তিনজন সদস্যকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন তারা। যাতে তারা সেন্টিনেলিজ লোকজনের কথার অনুবাদ আর আচরণের ব্যাখ্যা বুঝতে পারে।

তবে সেন্টিনেলিজ যোদ্ধারা খুবই রাগী আর অদ্ভুত মুখে তাদের মুখোমুখি হয়। তাদের হাতে ছিল তীর ধনুক। যেন বহিরাগতদের হাত থেকে তাদের নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য সবাই প্রস্তুত ছিল। হাত-পা বেঁধে রাখা একটি জীবন্ত শুকর তাদের উপহার দেয়া হয়েছিল। তবে সেটিকে তারা বর্শায় বেধে ফেলে এবং পরে মাটিতে পুতে রাখে।

বিচ্ছিন্ন এক জাতি

বিচ্ছিন্ন এক জাতি

বেশ কয়েকবারই এই দ্বীপের মানুষদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে তারা। বর্তমানে এই গবেষণা পুরোপুরি স্থগিত করে দিয়েছে ভারত সরকার। এই উপজাতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় নগ্ন এই মানুষগুলোর ভাষা দুর্ভোদ্য এক ভাষা। এই দ্বীপের আশেপাশে থাকা অন্য গোত্রগুলোর ভাষার অনেকটা কাছাকাছি ধরণের। সেন্টিনেলিজরা খুব লম্বাও নয়, খুব খাটোও নয়। তারা তীর ধনুক বহন করে। এই আদিবাসী গোত্রের লোকজন তীর ধনুক দিয়ে মাছ শিকার করে বলে জানা গেছে। বুনো শুকর, শিকড়, বনের ফলমূল আর মধু তাদের প্রধান খাবার।

১৮৭৯ সালে সারেতে জন্মগ্রহণকারী, মরিস ভিডাল পোর্টম্যান আন্দামানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হন। দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস পরে তিনি উত্তর সেন্টিনেলের একটি অভিযানের আয়োজন করেন। এই অভিযানে প্রাথমিকভাবে কোনো লোককে না পাওয়া পর্যন্ত দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় তারা। কয়েকদিন অনুসন্ধানের পরেও তারা এক বৃদ্ধ দম্পতি এবং চার শিশু পায়। তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য পোর্ট ব্লেয়ারে আনা হয়েছিল। তবে সেন্টিনেলিজরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বৃদ্ধরা কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়। এরপর বাচ্চাদের আবার দ্বীপে নিয়ে রেখে আসে তারা।

নগ্ন এক জাতি

নগ্ন এক জাতি

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মূলত চারটি আফ্রিকার উপজাতি গোত্র বাস করে। গ্রেট আন্দামানিজ, অনেজ, জারাওয়া এবং সেন্টিনেলিজ। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাস করে দুইটি মঙ্গোলয়েড গোত্র-শোম্পেন এবং নিকোবারিজ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর এই দ্বীপে একটি কারা কলোনি স্থাপন করে, যেখানে বন্দীদের আটকে রাখা হত। কিছুদিন পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেই তাদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে গ্রেটার আন্দামালিজ বাহিনীর সঙ্গে প্রথম লড়াই হয় ১৮৫৯ সালে। যার ফলাফল সহজেই ধারণা করা যেতে পারে।

যুদ্ধ এবং রোগের বিস্তারের কারণে স্থানীয় গোত্রগুলোয় দ্রুত জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। তবে সেন্টিনেলরা বাস করতো একটি দূরের দ্বীপে, ফলে এই দ্বীপের বাসিন্দা ঔপনিবেশিক শাসনের আওতার বাইরে থেকে যায়। অতীতে সেন্টিনেলিজরা একটি শান্তিপ্রিয় জাতি ছিল। তারা মানুষজনের ওপর হামলা করত না। তারা আশেপাশের এলাকায় কখনো যেত না বা কারো সঙ্গে ঝামেলাও তৈরি করত না। তবে ধীরে ধীরে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে।

গহীন জঙ্গলে তাদের বাস

গহীন জঙ্গলে তাদের বাস

নিজেদের এলাকার ব্যাপারে এই বাসিন্দারা খুবই রক্ষণশীল এবং বাইরের কাউকে পেলেই তারা আক্রমণ করে থাকে। ২০০৬ সালে দুই জন জেলে উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের কাছাকাছি গেলে আদিবাসীদের হামলায় নিহত হয়। ২০০৪ সালের সুনামির পর যখন ভারতীয় কর্মকর্তারা দ্বীপটির ওপর আকাশ থেকে জরিপ করার চেষ্টা করে, তখন দ্বীপের একজন বাসিন্দা তীর ছুড়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত করার চেষ্টা চালায়।

ভারতীয় নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ড এই এলাকার আশেপাশে নিয়মিত টহল দিতে চায়। তবে তা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে এরকম অনুপ্রবেশ ঘটে এবং মার্কিন এই পর্যটকের অনেক মানুষজন দ্বীপটিতে চলে যান। যা তারা একদমই পছন্দ করে না। তারা হয়তো এভাবেই বিশ্বের সব কিছু থেকে নিজেদের আড়াল করে রেখে ভালোই আছে। টিএন পন্ডিতের মতে, আমাদেরও উচিত তাদের বিরক্ত না করা। তারা আলাদা থাকতে চাইলে সেটিকে আমাদের সম্মান জানানো উচিত।

সূত্র: বিবিসি

পাঠকের মতামত

Comments are closed.