270327

স্যুপ খেতে ডলফিন হত্যা করে উৎসব পালন করে যে দেশ

পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে মানুষ। তবে মানুষ তার জীবনযাপনের সুবিধার জন্য কত কিছুই না করে থাকে। একেক দেশের রয়েছে একেক রীতিনীতি, আচার- সংস্কৃতি। ভাষা আর চেয়ারার আদলের মতোই খ্যাদ্যাভ্যাসেও রয়েছে নানান অমিল। তবে খাবারের যোগান দিতেই তারা পরিবেশকে ফেলছে হুমকির মুখে।

এই জাপানিজদের কথাই ধরুন না। পৃথিবীতে ১৯৩ টি দেশের মধ্যে যদি সভ্য আর শান্তিপ্রিয় দেশের কথা বলেন। তাহলে তালিকার শুরুর দিকেই থাকবে জাপানের নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত এই দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে খুব সাবলীলভাবেই। জাপানের নাম নিলেই মনে হয় যেন শান্তির সাদা পায়রা। তবে এই শান্তিপ্রিয় জাপানিদের বিরুদ্ধে আছে হত্যার অভিযোগ।

ডলফিন শিকার করে চলে উৎসব

ডলফিন শিকার করে চলে উৎসব

নিজের খেয়াল খুশিতেই তারা এই হত্যাগুলো করে থাকেন। একরকম দিনক্ষণ ঠিক করে উৎসবই পালন করেন তারা এজন্য। বলছি তাদের বর্বর এক উৎসবের কথা। তবে মানুষ নয় তারা নির্বিচারে হত্যা করে ডলফিন। সমুদ্রের এই নিরীহ স্তন্যপায়ী প্রাণী হত্যা যেন তাদের রীতিতে পরিণত হয়েছে। অবাক হয়েছেন নিশ্চয়? তবে চলুন জেনে নেয়া যাক এই বর্বর উৎসবের আদ্যোপান্ত-

জাপানের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল এবং প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তি তাইজি শহর। প্রতিবছর ১ সেপ্টেম্বর সেখানে শুরু হয় ডলফিন হান্টিং ড্রাইভ। এই উৎসব শেষ হয় পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনে। মারা যায় পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এবং নিরীহ প্রাণী ডলফিন। হাজার হাজার ডলফিন হত্যা করে তারা এই পুরো সময়জুড়ে। সে দেশের সরকার ২ হাজার ডলফিন হত্যার অনুমতি দেয়। তবে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১৫ হাজারে। এছাড়াও ডলফিন হত্যা করতে গিয়ে মারা পড়ে আরো প্রায় ২৫ হাজার সামুদ্রিক প্রাণী।

তবে জানেন কি? কেন এতো শান্তিপ্রিয় দেশটির মানুষেরা এমন নৃশংস কাজটি করে থাকে? স্যুপ খেতে! ডলফিনের পাখনা এবং তেল দিয়ে এক ধরনের স্যুপ রান্না করা হয় জাপানে। বেশ ব্যয়বহুল হলেও এ দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এই স্যুপ। এছাড়াও ডলফিনের মাংস জাপানিদের কাছে দুর্লভ এবং দামি একটি খাবার। ডলফিনের পাখনার এই স্যুপের দাম হয় কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত।

এভাবেই ফাঁদ পাতা হয় ডলফিনের জন্য

এভাবেই ফাঁদ পাতা হয় ডলফিনের জন্য

এমনকি ইউরোপ এবং আমেরিকার বড় বড় রেস্তোরাঁয় এটি বেশ জনপ্রিয় ম্যেনু। সেখানে আকাশ ছোঁয়া দামে বিক্রি হয় ডলফিনের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রান্না করা পদগুলো। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চোরায় পথে চলে যায় ডলফিনের মাংস। বেশ চড়া দামে বিক্রি হয় সেখানে এগুলো। ক্যান বন্দি হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায় হত্যার শিকার এই ডলফিনগুলো।

এখানেই শেষ নয়। জীবিত ডলফিনগুলোর জায়গা হয় অ্যাকুরিয়ামে। বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানা এবং ধনী এবং বিলাসি মানুষদের মনোরঞ্জনের জন্য জীবিত ডলফিন ধরা হয়। এদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নানাভাবে। বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে কাটে তাদের জীবন। সার্কাসের এক অংশ হয়ে যায় সমুদ্রের এই প্রাণী।

রেস্তোরাঁর দামি দামি পদ তৈরি করা হয় ডল\ফিনের মাংস দিয়ে

রেস্তোরাঁর দামি দামি পদ তৈরি করা হয় ডল\ফিনের মাংস দিয়ে

সেপ্টেম্বরের ফেলা দিন তাইজির কিছু দক্ষ শিকারি হাজির হয় প্রশান্ত মহাসাগরে। গভীর সমুদ্রে চলে যায় কয়েকশ ট্রলার। ডলফিনের ঝাঁক দেখতে পাওয়ার পর একটি ফাঁদ তৈরি করে তারা। একটা ট্রলার থেকে স্টিলের পাইপের এক প্রান্ত সমুদ্রের পানিতে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর একটি কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পাইপে আঘাত করা হয়।  সুরেলা একটা শব্দের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের পানিতে ।

ডলফিনরা সেই আওয়াজে আকর্ষিত হয়ে ট্রলারটির আশপাশে পাক খেতে থাকে। ট্রলারগুলি থেকে ছুঁড়ে দেয়া হয় ছোট ছোট মাছ। তারপর পানির নিচে শব্দ তৈরি করতে করতে ট্রলারটি রওনা দেয় তীরের দিকে। পিছনে ‘U’ আকৃতির ব্যুহ তৈরি করে তীরের দিকে এগোতে থাকে বাকি ট্রলারগুলোও। ডলফিনরা জানতে পারে না, তাদের পিছন পিছন সমুদ্রের জলে নেমে পড়তে শুরু করেছে বিশাল এক জাল। যা তাদের আর সমুদ্রে ফিরে যেতে দেবে না।

দক্ষ শিকারিরাই এই ডলফিনগুলো ধরেন

দক্ষ শিকারিরাই এই ডলফিনগুলো ধরেন

এই ভাবে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো শব্দের জাদুতে  ডলফিনদের সম্মোহিত করে একটি নির্দিষ্ট খাঁড়ির দিকে নিয়ে আসে তাইজির শিকারিরা। যে খাঁড়ির ভেতরে ডলফিনরা ঢুকতে পারবে, কিন্তু বেরোতে পারবে না। কারণ বেরোবার পথ জাল দিয়ে বন্ধ করা। খাঁড়িতে আটক হওয়া ডলফিনগুলো প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে ছটফট করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারী জাল কেটে বেরোতে পারে না। তাদের শান্ত করার জন্য সারারাত তাদের কোনো ক্ষতি করা হয় না। অনেক সময় ছোট ছোট মাছ খাবার জন্য দেওয়া হয়। সকাল হতেই বোটে করে জলে নেমে পড়ে শিকারিরা।

অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য যে ডলফিনগুলিকে জীবিত রাখা হবে, তাদের রেখে দেওয়া হয় বড় জালের মধ্যে। যে ডলফিনগুলোকে মাংসের জন্য মারা হবে, তাদের কে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আরেকটি জালের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর পর জালটিকে টেনে টেনে অগভীর পানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে ডলফিনদের হারপুন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হত। তারপর লম্বা করাত দিয়ে গলা কেটে ফেলা হত। কিন্তু জাপান সরকার বর্তমানে সেটা নিষিদ্ধ করেছে।

ডলফিনের স্পাইনাল কর্ডের ভেতর লম্বা একটি ধাতব রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তাতে নাকি মুহূর্তের মধ্যে মারা যায় ডলফিনটি। শরীরের সব রক্ত গিয়ে মিশছে পানিতে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীলচে-সবুজ পানি যেন ডলফিনের রক্তে আলতা মাখছে পায়ে।

ডলফিনের পাখনার স্যুপ তাদের প্রিয় খাবার

ডলফিনের পাখনার স্যুপ তাদের প্রিয় খাবার

বাণিজ্যিক ভাবে ১৬০৬ সাল থেকে তাইজি তিমি, হাঙর, ডলফিন মেরে আসছে। শুরু করেছিলেন তিমি শিকারি ইয়োরোমোতো। প্রাথমিক ভাবে তিনি ছোটো নৌকা করে সমুদ্রে গিয়ে হার্পুন দিয়ে তিমি শিকার করতেন। ১৬৭৫ সাল থেকে তিমি শিকারের জন্য জাহাজ ভাসাতে শুরু করল তাইজির মৎস ব্যবসায়ীরা। ধীরে ধীরে সারা জাপানে ছড়িয়ে পড়েছিল তিমি,হাঙর,ডলফিনের শিকার ও মাংস রপ্তানির ব্যবসা। তাইজিতে এই বাৎসরিক ডলফিন শিকার, উৎসবের আকার ধারণ করে ১৯৬৯ থেকে।

সেপ্টেম্বরের এক তারিখ থেকে শুরু হয় এই নির্মম ইরুকা হত্যালীলা। ডলফিনকে জাপানিরা বলে ইরুকা। চলে পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত। পুরো ছ’মাস তাইজি গ্রামের সমুদ্রতটের বালির রঙ  লাল হয়ে যায়। গোনডো( তিমি) শিকার শেষ হয় আরও দু’মাস পরে। এপ্রিলের শেষে। এই উৎসবে মারা হয় বটল নোজ ডলফিন, প্যানট্রপিক্যাল স্পটেড ডলফিন, প্যাসিফিক হোয়াইট সিটেড ডলফিন, শর্ট ফিন পাইলট হোয়েল, রিসসোস ডলফিন, স্ট্রাইপড ডলফিন। এছাড়াও ফলস কিলার হোয়েল মারা হয় প্রচুর সংখ্যায়।

খেলা দেখিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে এরা

খেলা দেখিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে এরা

চিত্র পরিচালক হার্ডি জোন্স ব্লুভয়েজ ডট ওআরজি সংস্থার হয়ে ২০০০ সালে প্রতিবাদ শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন হলিউড অভিনেতা টেড ড্যানসন। তারা বহুবার তাইজিতে যান। ডলফিন হত্যা নিয়ে তৈরি করেন ছবি দ্য ডলফিন ডিফেন্ডার। সেই প্রথম বিশ্বের সামনে আসে তাইজির নৃশংসতা। শুরু হয় প্রতিবাদ, সারা বিশ্ব জুড়ে।

সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রতিবাদের ঢেউ শুরু হয়। লড়াই শুরু করে তাইজি টুয়েলভ নামে এক সংগঠন। ২০০৩ সালে তাইজিতে, রাতের অন্ধকারে জাল কেটে ডলফিনদের ছেড়ে দেন দুই প্রতিবাদী যুবক। তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু এরপর তাদের আর খোঁজ মেলেনি। তাইজি ডলফিন হান্টিং ড্রাইভ নিয়ে ২০০৯ সালে তৈরি করা হয় একটি বিখ্যাত তথ্যচিত্র, দ্য কেভ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, তাদের মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম গুলিতে জাপান থেকে আমদানি হওয়া ডলফিন রাখা নিষিদ্ধ করে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.