269213

অত্যাচারী জমিদারের বাড়ি এখন গরু-ছাগলের খামার

শত বছর আগে এই জমিদার বাড়ির কদর ছিল আকাশচুম্বী। সিরাজগঞ্জের পোতাজিয়া ও রাউতারা অঞ্চলের অত্যাচারী জমিদার রুধেষ বাবু গড়ে তুলেছিলেন বিলাস বহুল এই রাজবাড়ি। প্রায় ১০ একর এলাকা জুড়ে এই বাড়িটির চার পাশ ১০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। বর্তমানে সেই বাড়িটিই গরু-ছাগলের খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পোতাজিয়া ইউনিয়নের বড়াল নদীর তীরে অবস্থিত জমিদার রুধের কাবুল বিলাসবহুল বাড়িটি সংস্কার করা হলে এটিকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র, এমনই মত এলাকাবাসীর। শতবর্ষ প্রাচীন রুধেষ বাবুর জমিদার বাড়িটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ কুটিরে পরিণত হয়েছে। এটি ব্যবহৃত হচ্ছে গরু-ছাগলের খামার হিসেবে।

এককালে খুব দাপটের সঙ্গে চলতো রুধেষ বাবুর জমিদারী কার্যক্রম। এই জমিদার বাড়ির ভিতর ২৫টির বেশি ছোট-বড় অসংখ্য-কক্ষ, জলসা ঘর, কারাগারসহ প্রশাসনিক কার্যক্রমের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান ছিল। তার আমলে সাধারণ প্রজারা বেশ অসহায় জীবনযাপন করতো।

জমিদার বাড়ি

জমিদার বাড়ি

রাউতারার পশ্চিমপাশে ইটাখোলার ভিটা। পরিত্যক্ত ওই ভিটার নাম শুনলে এখনো গভীর রাতে চমকে উঠি। ওটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কত শত ভয় আর ভীতির মিথ। বিস্তীর্ণ জলরাশি পেরিয়ে রাউতারা, পোতাজিয়া ও বাড়াবিল গ্রাম। এরপরই ইতিহাসধন্য শাহজাদপুর উপজেলা সদর।

ইউসুফশাহী পরগোনার অন্তর্ভুক্ত ছিল এ অঞ্চল। ১৮৭২ সালে প্রজা বিদ্রোহের যে সূত্রপাত ঘটে সেটা এ শাহজাদপুর থেকেই। গত শতাব্দী অবধি এ সুবিশাল পাথর ও জলাভূমির কর্তৃত্ব ছিল জমিদার ও জোতদারদের অধীনে। কথিত আছে, চতুর্দশ শতকের প্রাক্কালে সুদূর ইয়ামেন থেকে আগত সুফি সাধকদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। পোতাজিয়া নামক গ্রামে তাদের নৌ-বিহার পোতাশ্রয় করে। এ জন্য নাকি গ্রামের নাম পোতাজিয়া।

পোতাজিয়া গ্রামের পাশেই রাউতারা গ্রাম। বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের একটি গ্রাম। বড়াল নদীর জলাধারা বয়ে গেছে এ গ্রামের বুক চিরে। পাখির কলকাকলি আর গরুর হাম্বা ডাকে ঘুম ভাঙে এতদাঞ্চলের মানুষের। এদের প্রভাব আর প্রতাপের কথা প্রচলিত আছে, সেকালের প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন রুধেষ বাবু। এলাকার মানুষ রুধেষ বাবুর জমিদার বাড়ি নামেই চেনে।

গরু-ছাগলের খামার

গরু-ছাগলের খামার

একবার মজার ঘটনা এক ঘটে, এ জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন নৌকা, পাল তোলা নৌকা ডিঙি, কোষাসহ বাহারি সাজের বাইচের নৌকার বহর। বাইচের বাহারি নৌকা দেখার জন্য যুবতি কন্যারা ওই জমিদার বাড়ির ছাদে ওঠে। তখন মাঝিরা সমস্বরে সারি গেয়ে ওঠে, ‘তারায় জলে ঝিকমিক ঝিকমিক চান্দে দ্যায় আলো/ রাউতারার ছেরিরা প্রেম জানে ভালো/ ও হায় প্রেম জানে ভালো।’

পাঁচতলা বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়িতে আছে সুরঙ্গ পথ। ছাদে উঠার জন্য রয়েছে কয়েকটি সিঁড়ি। রুধেষ বাবু প্রতিদিন রাতেই তার জলসা ঘরে এলাকার সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে নাচ গান করাতো। মদের নেশায় মেতে উঠতো জমিদার রুধেষ ও তার অধিনস্ত কর্মচারীরা। বাড়িটি বড়াল নদীর তীরে হওয়ায় নৌপথে যাতায়াত করতো জমিদার।

আরো পড়ুন: রহস্যময় জাহাজ থেকে উধাও ৫০ যাত্রীর খোঁজ মেলেনি ১৫০ বছরেও

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছিল বাড়ি থেকে নদীতে নামার জন্য সিঁড়ি। এ সিঁড়ি দিয়েই জমিদার ও তার পরিবারের সদস্যরা নদীতে গোসল করতো। নদীর সম্মুখভাগে নির্মাণ করা হয়েছিল বিশাল উঁচু দেয়াল। কথিত আছে, নদী থেকে মাঝে মধ্যেই কুমির জমিদারের বাড়িতেই উঠে আসতো বাড়ির লোকজনকে আক্রমণ করতো। কুমিরের উপদ্রব ও আক্রমণ থেকে রেহাই পেতেই নদীর সম্মুখে বিশাল উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল।

শত শত বছরের স্থাপনা এটি

শত শত বছরের স্থাপনা এটি

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো জমিদারী শাসনের অবসান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রুধেষ বাবুর জমিদারীও বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে বিলাসবহুল জমিদার বাড়ি ফেলে রেখে পাড়ি জমায় ভারতে। ধীরে ধীরে অযত্ন ও অবহেলায় জমিদার বাড়িটি তার ঐতিহ্য হারিয়ে ধ্বংসাবশেষের পরিণত হতে থাকে। বাড়িটির মূল্যবান কপাট, জানালা, লোহার রড, রেলের বড় বড় চেইন সব চুরি হয়ে যায়। বাড়িটি দখল হয়ে যেতে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে।

বর্তমানে পুরো জমিদার বাড়ির ভবনগুলো বিভিন্ন গাছগাছালিতে ভরপুর হয়ে ইট ও সিমেন্টের তালাই খসে পড়েছে। জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে দেয়ালগুলো। ভিতরের রুমগুলো আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গরু-ছাগলের চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিলাসবহুল বাড়িটি দেখার জন্য উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দর্শনার্থী আসে নিয়মিত। তাদের ধারণা, জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় রক্ষণাবেক্ষণ করলে হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং সরকার পেতে পারে রাজস্ব

পাঠকের মতামত

Comments are closed.