268811

ঢাকার প্রথম মসজিদ যে কারণে নারীর নামেই নামকরণ করা হয়

সমৃদ্ধ ঢাকার ইতিহাস ঘাটলে মসজিদ পাওয়া যায় অনেক। প্রায় সাত হাজার ছোট বড় মসজিদ রয়েছে শুধু ঢাকা শহরেই। এজন্য মসজিদের শহরও বলা হয় ঢাকাকে। ঢাকার ইতিহাসে নজর দিলে দেখা যায় সময়ের বিবর্তনে এখানে রয়েছে নানান স্থাপত্যরীতির মসজিদ। একুশ শতকের এই সময়ে এসে ঢাকার মসজিদগুলোর স্থাপত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও পুরনোগুলো এখনো দৃষ্টিনন্দন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম নিদর্শন তাদের মসজিদ।

আজ থাকছে ঢাকার পুরনো মসজিদের মধ্যে অন্যতম একটি মসজিদের কথা। এটি এখানকার প্রথম মুসলিম স্থাপত্য এবং ঢাকার সবচেয়ে পুরনো স্থাপত্য বলেও স্বীকৃত। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ সকল মসজিদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরনো ঢাকায় অবস্থিত। পুরনো ঢাকার ৬ নং নারিন্দা রোডে অবস্থিত বিনত বিবির মসজিদ ঢাকার প্রথম মসজিদ তথা এই অঞ্চলের প্রথম মুসলিম স্থাপত্য। একই সঙ্গে ঢাকায় কোনো নারীর নামে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র মসজিদও এটি। এখনো গৌরবের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার সর্বপ্রথম মসজিদ হিসেবে পরিচিত নারিন্দা বিনত বিবির মসজিদটি।

বিনত বিবির মসজিদের ইতিহাস

বিনত বিবির মসজিদ সুলতানি আমলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি মধ্যযুগীয় মসজিদ। এই মসজিদের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানামত। এরমধ্যে দুইটি গল্প সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। ধারণা করা হয়, ১৪৫৬ খ্রিস্টব্দে ইসলাম খাঁর আগমনের প্রায় দেড়শ বছর আগে বাংলার সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের আমলে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি নির্মিত হয়। আবার ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানী বলেছেন, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৩৫-১৪৫৯) মার মারহামাতের মেয়ে মুসাম্মদ বখত বিনত ১৪৫৭ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন।

বিনত বিবির মসজিদ

বিনত বিবির মসজিদ

এটি ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর একটি। যা প্রায় ৬০০ বছর আগেকার প্রতিষ্ঠিত। তবে মসজিদের প্রধান ফটকের কালো পাথরের শিলালিপি এই মসজিদের প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্য ইতিহাসের জানান দেয়। এই শিলালিপির তথ্যানুসারে, তখনকার সময়ে পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে বণিকরা ব্যবসা করতে আসত। সেই অঞ্চল থেকে আসা এক বণিকের নাম ছিল ছিল আরাকান আলী। তিনি পুরান ঢাকার নারিন্দা অঞ্চলে এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

যে কারণে নারীর নামে নামকরণ করা হয় মসজিদটির

মসজিদটি আরাকান আলী তার আদরের কন্যা বিনত বিবির নামে নামকরণ করেন। বিনত বিবি মারা গেলে মসজিদের প্রাঙ্গণেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।  আরাকান আলীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকেও তার মেয়ের পাশে সমাহিত করা হয়। মসজিদের দুটি গম্বুজের একটিতে প্রথম প্রতিষ্ঠার সাল লেখা আছে। আরেকটি গম্বুজে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিনত বিবির এই মসজিদে প্রথমবারের মত সংস্কারকাজে হাত দেয়া হয় ১৯৩০ সালে। মসজিদে যে শিলালিপিটি পাওয়া গিয়েছিল ধারণা করা হয়, ঢাকায় এটিই সর্বপ্রথম কোনো মুসলিম শিলালিপি। কেননা এর আগের কোনো প্রতিষ্ঠিত মসজিদের হদিস পাওয়া যায়নি এখনো। হয়তো সেসব মসজিদের ধ্বংসস্তুপের কিছুই ইতিহাস অবশিষ্ট দেখতে পারেনি বলে বিনত বিবির মসজিদকেই বলা হচ্ছে ঢাকার প্রথম মুসলিম স্থাপত্য বা মসজিদ।

বিনত বিবির মসজিদ

বিনত বিবির মসজিদ

আরেক ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৮৬১ হিজরিতে নারিন্দা রোডস্থ এ মসজিদটির প্রথম সংস্করণ করা হয় এবং ৮৬৬ হিজরিতে বিনত বিবি ও আরাকান আলীর সমাধিস্থলে একটি মাজার স্থাপন করা হয়। বাংলা ১৩৩৭ সালে এ মসজিদটির দ্বিতীয় সংস্করণ করা হয় এবং দ্বিতীয় গম্বুজটি স্থাপন করা হয়। প্রায় ২০০ বছর ধরে এলাকাবাসী একটি কমিটির মাধ্যমে এ মসজিদটির দেখাশোনা করে আসছেন। ঐতিহাসিক এ মসজিদে সংস্কার করে আধুনিক যুগের ছোঁয়া দেয়া হয়েছে। এতে করে স্থাপত্যটি তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পেরেছে ঠিক কিন্তু বিলীন করে দেয়া হয়েছে শত বছরের ঐতিহ্য।

ঢাকার প্রথম মসজিদ বলে খ্যাত এই স্থাপত্যে নতুন করে দোতলা সংযোজন করা হয়েছে। এলাকাবাসী ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে বর্তমানে পুরনো ভবন ঠিক রেখে নতুন তিন তলা মসজিদ ভবণ নির্মিত হয়েছে। উত্তর পাশ ছাড়া বাকি অংশগুলো সংস্কার  করে নতুনত্ব নিয়ে আসা হয়েছে। খুব কম অংশকেই এখন সেই বিনত বিবির মসজিদের অঙ্গ বলে ধরে নেয়া যায়। এতো প্রাচীন মসজিদকে বেশ অবহেলার সঙ্গেই মূল্যায়ন করেছে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর। তারা নেয়নি কোনো সংরক্ষণের উদ্যোগ। তাই শুধু এই মসজিদই নয় ঢাকার শত বছরের পুরনো অনেক স্থাপনাই অবহেলা আর বাণিজ্যিকীকরণ এর ফাঁদে পড়ে হারিয়ে গেছে।

তবে এখন বিনত বিবির মসজিদ ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু নামেই। চাইলেই ছুটির দিনে পরিবার প্রিয়জন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। ঢাকার এই প্রাচীন মসজিদে যেতে পারবেন ঢাকার যে কোনো প্রান্ত থেকে। এজন্য যেতে হবে আপনাকে পুরোনন ঢাকার নারিন্দা রোডে। ৬ নং নারিন্দা রোডে বেশ নীরবেই কালের সাক্ষী হয়ে আছে সুলতানি যুগের এই প্রাচীন মসজিদ।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.