268752

ডাইনি অপবাদে হাজারো নারীকে হত্যার নির্মম রীতি আজো চলমান

অতীতে কারো মধ্যে সামান্য বিকারগ্রস্থতা দেখলেই মানুষ তাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিত। এমনকি শিশুরাও এই অপবাদ থেকে মুক্তি পেত না। তখনকার সময় সমাজের সব মানুষেরা হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ত। হাজারো দর্শকের সামনে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মুত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত।

১৫৫৫ এর একটি লিফলেটে ডেরেনবুর্গের ডাইনি অভিযো্গে একজনকে পোড়ানোর নৃশংস দৃশ্য অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ইউরোপে ডাইনি শিকার যখন চরম রূপ নিয়েছিল, তখনকার ঘটনা এটি। জার্মানিতে ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মানুষকে ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তবে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই নারী।

ফেলা হত পানিতে

ফেলা হত পানিতে

অদ্ভুত পরীক্ষা

ডাইনিদের বিরুদ্ধে বিচার হত ‘বৈধ’ আইনি পদ্ধতিতে। একজন নারী ডাইনি কিনা তা বিচার করা হত নিষ্ঠুরতম এক পরীক্ষার মাধ্যমে। এটাকে বলা হত ‘সাঁতার পরীক্ষা’৷ অভিযুক্তকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়া হত। যারা ডুবে যেতো তারা নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হত। আর যারা বাঁধন খুলে সাঁতরে উঠে আসতো তাদের ডাইনি বলা হত। ধারণা করা হত তারা শয়তানের সাহায্যে এটা করতে পেরেছে।

জিজ্ঞাসাবাদ

অভিযুক্ত প্রত্যেককে তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হত। বলা বাহুল্য এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া ছিলো নির্যাতনের মাধ্যমে দোষ স্বীকারে বাধ্য করা। সেসব প্রক্রিয়া যে কতটা ভয়াবহ ছিলো উপরের ছবিটি তার প্রমাণ।

আগুনে পোড়ানো হত

আগুনে পোড়ানো হত

ডাইনি শিকারের ‘বাইবেল’

১৪৮৬ সালে ডোমিনিকান সন্ন্যাসি হাইনরিশ ক্রেমার ‘হ্যামার অব হুইচেস’ নামে এক বই প্রকাশ করেন। এই বইটিতে ডাইনিদের নির্যাতনের কত ধরনের প্রক্রিয়া হতে পারে তার বর্ণনা এবং আইনি প্রক্রিয়ার পূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে। ১৭ শতাব্দীর পর এটি ছাপানো বন্ধ হয়ে যায়। এই বইটি সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

জোয়ান অব আর্ক

ফরাসি এই বীর যোদ্ধা ১৪২৯ সালে ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। এ কারণে ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের শতবর্ষের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর জোয়ান অব আর্ককে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে আটক করা হয়। ইংরেজ যাজকের অধীনে তার বিচার শুরু হয় এবং তাকে ডাইনি অ্যাখ্যা দিয়ে ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে পুড়িয়ে মারা হয়।

জোয়ান অব আর্ক

জোয়ান অব আর্ক

অ্যাগনেস বার্নয়ার এর ঘটনা

প্রাক-আধুনিক ইতিহাসের বিখ্যাত অপরাধ মামলা এটি। বাভেরিয়ার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী তৃতীয় আলব্রেখটের প্রেমিকা ছিলেন অ্যাগনেস। আলব্রেখটের বাবা অ্যাগনেসকে ডাইনি বলে প্রচার করে এবং ১৪৩৫ সালে দানিয়ুব নদীতে ডুবিয়ে মারা হয় তাকে।

ক্যাথরিনা হানোটের ঘটনা

কলোনের রাজনীতিবিদ পরিবারের ক্যাথরিন বর্তমানে সফল ব্যবসায়ী নারী হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই তার বিরুদ্ধে ডাইনি অভিযোগ আনা হয়। সেইসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক অত্যাচার সহ্য করেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তিনি। ১৬২৭ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে ক্যাথরিনের শাস্তি কমানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ তার দেহ আগুনে ছোড়ার আগে গলা টিপে হত্যা করা হয় তাকে।

কঠিন শাস্তি দেয়া হত ডাইনিদের

কঠিন শাস্তি দেয়া হত ডাইনিদের

গুয়ের্নসের শহীদ

১৫৫০ সালে ইংলিশ চ্যানেলের দ্বীপ গুয়ের্নসে অনেক ডাইনির বিচার হয়। সেসময় প্রোটেস্টেন্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলছিল। ১৫৫৬ সালে তিনজন প্রোটেস্টেন্ট নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে। এর মধ্যে একজন নারী জ্বলন্ত অবস্থায় এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। সেসময় নারীটিকে উদ্ধার করা হয়। তবে পরে আবারো তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। বর্তমানে সেই তিন নারী ‘গুয়ের্নসের শহীদ’ হিসেবে খ্যাত।

নিউ ইংল্যান্ডে ডাইনি শিকার

১৯৬২ সালে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে ডাইনি শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস, যা তখন ছিল সালেম। ব্রিটিশরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সাহায্য নিয়েছিল ডাইনি শিকারের। নিউ ইংল্যান্ডে ১৪ জন নারী এবং পাঁচজন পুরুষকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। নির্যাতন করা হয়েছিল কয়েকশ মানুষকে।

বর্তমানের ডাইনি!

বর্তমানের ডাইনি!

এখনো আছে উইচ হান্ট

৩৬টি দেশে এখনো ডাইনি শিকার অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ক্যাথলিক মিশনারি সোসাইটি মিসিও। জার্মান ইতিহাসবিদ ভল্ফগাং বেহরিঙ্গেরের মতে, ওই ৩০০ বছরে ডাইনি সন্দেহে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা চেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে আধুনিক সভ্য যুগে। বিশেষ করে আফ্রিকায়। ১৯৬০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তানজানিয়ায় ডাইনি সন্দেহে ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আফ্রিকার বয়স্ক, নিঃসঙ্গ নারীরাই এর শিকার হন বেশি।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.