মিশরীয়দের রহস্যময় জীবনযাপন, মৃত্যু নিয়ে ছিল অধিক ভয়
চীন মিশরের জনগণের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক বেশ কিছু রীতিনীতি, সংস্কৃতি প্রগাঢ় রূপ ধারণ করেছিল। যে কারণে ক্ষমতাধর ফারাওরা পিরামিড এবং মন্দির নির্মাণের জন্য জনগণকে শ্রম দিতে বাধ্য করত।
জানা যায়, একই উদ্দেশ্যে তারা হিব্রুদের দাসে পরিণত করেছিল। বাস্তবে প্রাচীন মিশরীয় সব শ্রেণির জনগণ তাদের জীবনকে ভালোবাসত। তাদের সরকার দাসদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। প্রাচীন অন্যান্য সভ্যতায়ও এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। তবে এক্ষেত্রে মিশরীয়দের নির্দিষ্ট কোনো জাতিকে ব্যবহারের জন্য বিবেচনায় রাখার নিয়ম ছিল না।
প্রাচীন মিশরীয়রা অ-মিশরীদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, তারাই বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জীবনযাপনকারী। প্রাচীন মিশরীয়রা নিজেদের জীবনধারাকে এতোটাই নিখুঁত মনে করত যে, তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে পৃথিবীর জীবনের চিরন্তন ধারবাহিকতা হিসেবে কল্পনা করত।
মিশরীয়রা সাধারণত অপরাধী কিংবা যুদ্ধ বন্দিদের দাস হিসেবে ব্যবহার করত। তাদের বিবেচনা ছিল দাসে পরিণত হওয়া ব্যক্তিরা কর্মের দ্বারা কিংবা যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা হারিয়েছে। এজন্য তাদেরকে নগণ্য হিসেবে গণ্য করা হত। অবশ্য মিশরের পিরামিড এবং অন্যান্য বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভগুলো তৈরি করা ব্যক্তিরা শ্রমের মূল্য পেত। তাদের অনেকেই স্থাপত্য এবং শিল্পের বিষয়ে খুবই দক্ষ ছিল।
এই স্মৃতিস্তম্ভগুলো মৃত্যুর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নয় বরং জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নির্মিত হয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, এগুলো ব্যক্তি জীবনকে অনন্তকাল স্মরণ করাবে। মৃত্যু শুধু একটা রূপান্তর মাত্র যা তাদের অনন্তকালীন জীবনে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
মৃত্যু কেন্দ্রিক বিশ্বাস, রীতিনীতি ছাড়াও মিশরীয়রা দৈনন্দিন জীবনযাপনও উপভোগ করত এবং তা স্মরণীয় করার প্রতিও তাদের মনোনিবেশ ছিল। কৃষি কাজ, স্মৃতিস্তম্ভ এবং মন্দির তৈরির জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করত। তেমনই তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন ছিল উপভোগ্য। প্রাচীন মিশরে জাদুবিদ্যার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
তাদের জাদুর দেবতা ছিল হেকা। এই দেবতাতেকে তারা চিকিৎসক হিসেবেও ভাবত। তাদের মধ্যে, সম্প্রীতি এবং ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে মা’আত হিসেবে পরিচিত একটি ধারণা প্রচলিত ছিল। সেসময় জ্ঞান চর্চার অভ্যাস ছিল মিশরীয় জনগণের মধ্যে। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরের সব শ্রেণির জনগণ নিজেদের জীবনকে মূল্যায়ন করত এবং সাধ্য অনুযায়ী উপভোগও করত।
সামাজিক শ্রেণি বিভক্তি
প্রাচীন মিশরের জনগণের মধ্যে সামজিক শ্রেণি বিভক্তির রীতি বেশ প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজার অবস্থান ছিল সবার উপর। এরপর ক্রমান্বয়ে মুখ্যমন্ত্রী, রাজসভার সদস্য, বিচারকমণ্ডলী, আঞ্চলিক গভর্নর, সামরিক বাহিনীর জেলারেল এবং বিভিন্ন সরকারি কর্মক্ষেত্রের তত্ত্বাবধায়কদের অবস্থান ছিল। সাবার শেষ অবস্থান ছিল কৃষক শ্রেণির। সামাজিক পরিবর্তন কিংবা গতিশীলতায় তারা উৎসাহী ছিল না। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, দেবতারা নিখুঁত সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্তর সৃষ্টি করেছেন।
তারা মনে করত, দেবতারা মানুষকে সব কিছুই দিয়েছেন এবং রাজাকে তাদের ইচ্ছা বুঝতে ও বাস্তবায়ন করতে সর্বাধিক ক্ষমতাশালী হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রাচীন মিশরের প্রাক রাজবংশীয় যুগ থেকে পুরাতন রাজ্যের সময় (২৬১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২১৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পর্যন্ত রাজাকে দেবতা এবং মানুষের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হত।
এসময় সূর্যদেবতা ‘রে’ এর পুরোহিতরা ক্ষমতাধর হতে শুরু করে। এই সময়ের পরেও রাজা ঈশ্বরের মনোনীত দূত হিসেবে বিবচিত হত। এমনকি নতুন রাজ্যের খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১৫৭০ থেকে ১০৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাদের পর্যন্ত এই অংশেও রাজাকে ঈশ্বরের মনোনীত বলে সম্মান করা হত। যদিও এসময় থিবেসের আমুনের পুরোহিতরা রাজার থেকেও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল।
প্রাচীন মিশরের উচ্চ শ্রেণি
মিশরের ফারাওরা দেবতাদের নির্ধারিত ব্যক্তি হিসেবে বিবচিত হত। তারা প্রচুর ধন সম্পদ এবং মর্যাদার অধিকারী ছিল। তাদের বিলাসবহুল জীবন বেশিরভাগ জনগণের কল্পনারও বাইরে ছিল। মা’আত রীতি অনুযায়ী সম্প্রীতি এবং ভারসাম্য রক্ষা করে রাজ্য পরিচালনা করার বিষয়ে তারা সচেষ্ট ছিল।
রাজারা তাদের মর্যাদা এবং দায়িত্ব অনুযায়ী বিলাসিতাকে প্রাধান্য দিত। শিলালিপি থেকে কিংবা চিত্র থেকে জানা যায়, রাজারা শিকারে অভ্যস্ত ছিল। বেশি সংখ্যায় এবং ভয়ঙ্কর প্রাণী শিকার তাদের জন্য গর্বের বিষয় ছিল। সাধারণত সিংহ এবং হাতির মতো প্রাণী রয়েল গেম ওয়ার্ডেনরা ধরে আনার পর রাজা হত্যা করত। তবে হাস্যকর বিষয় হলো, রাজারা জঙ্গলে শিকার করতে ঠিকই যেত কিন্তু তার আগেই ওই জঙ্গল থেকে ভয়ঙ্কর প্রাণী মেরে ফেলা হত। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও ছিল।
আরো পড়ুন: ২৫০০ বছরে ধারাবাহিকভাবে ৩১টি রাজবংশ শাসন চালায় মিশরে
তখনকার সময় আদালতের সদস্যরাও উচ্চ শ্রেণির মর্যাদা ভোগ করত। যদিও তাদের দায়িত্ব ছিল খুবই সামান্য। আঞ্চলিক গভর্নররাও উচ্চ শ্রেণির ছিল তবে তাদের সুযোগ সুবিধা নির্ভর করত তাদের অধীনস্থ অঞ্চল কতটা সম্পদশালী এবং রাজার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
লিপিকার এবং চিকিৎসক
প্রাচীন মিশরে লিপিকাররা উচ্চপদস্থ ছিলেন। মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, তারা জ্ঞান এবং লেখার দেবতা থোথ এর মনোনীত। লিপিকারদের দায়িত্ব ছিল স্থায়ী রেকর্ড রাখার। একজন লিপিকারের কাজ অমর হিসেবে মনে করা হত। আর স্বয়ং দেবতারাই তাদের অমরতার বিষয়ে সচেতন ছিল বলে মনে করত প্রাচীন মিশরীয়রা।
বেশিরভাগ লিপিকার পুরুষ হলেও নারী লিপিকার থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। নারী লিপিকাররাও পুরুষ লিপিকারদের মতো মর্যাদা পেতেন। প্রাচীন মিশরের সব যাজক লিপিকার ছিল তবে সব লিপিকার পুরোহিত ছিল না। প্রাচীন মিশরে চিকিৎসক হতে গেলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হত। প্রচুর চিকিৎসা সংক্রান্ত শাস্ত্র পড়ে তবেই কেউ চিকিৎসক হতেন। এ কারণেই তারা প্রথমেই প্রশিক্ষণ শুরু করত লিপিকার হিসেবে।
মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল বেশিরভাগ রোগব্যাধি দেবতাদের পক্ষ থেকে হয়। পাপের শাস্তির কারণে রোগব্যাধি হয় বলে তারা মনে করত। চিকিৎসকরা সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য সে সময়ের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ত। যেখান থেকে তারা দাঁতের চিকিৎসা, সার্জারি, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোসহ অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ত্ত করে।
প্রাচীন মিশরে ধর্মীয় এবং দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে পার্থক্য ছিল না। তখনকার চিকিৎসকরা সাধারণত পুরোহিত ছিলেন। দেবী সের্কেট এর পুরোহিতরা সবাই চিকিৎসক ছিলেন। সেসময় অনেক নারী চিকিৎসক ছিলেন। অনেক নারী লিপিকারও চিকিৎসক ছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসের প্রথম নারী চিকিৎসক অ্যাগ্নোডাইস মিশরে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন করতে গিয়েছিলেন। কারণ মিশরে নারীদের উচ্চ সম্মান ছিল এবং গ্রিসের চেয়ে অনেক সুযোগ সুবিধা ছিল।
মিশরীয় সামরিক বাহিনী
প্রাচীন মিশরের মধ্যকালীন সময়ের পূর্বে আঞ্চলিক গভর্নররা নিজের অঞ্চলের সুরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন করত। প্রয়োজন মতো ফারাওদেরও এই বাহিনীতে যুক্ত করা হত। মধ্যকালীন সময়ের ১২ তম রাজবংশের ফারাও প্রথম আমেনেমহাট কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে স্থায়ী সামরিক বাহিনী গঠন করে। তার শাসনামল ছিল আনুমানিক ১৯৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। প্রথম আমেনেমহাট সরাসরি সামরিক বাহিনী তার অধীনে নিয়ে আঞ্চলিক গভর্নরদের ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা হ্রাস করে।
সেনা সদস্যরা উচ্চ এবং নিম্ন শ্রেণির কমান্ডারদের দ্বারা পরিচালিত হতো। প্রাচীন মিশরের নতুন রাজ্যের পূর্বে মিশরীয় সামরিক বাহিনী নিজেদের প্রতিরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করত। তবে ফারাও তৃতীয় তুতমোজ (১৪৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৪২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং দ্বিতীয় রামেসিস (১২৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১২১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এর মতো ফারাওরা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।
প্রাচীন মিশরীয়রা সাধারণত নিজেদের ভূখণ্ড ব্যতীত অন্য ভূখণ্ডে ভ্রমণ এড়িয়ে চলত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল অন্য স্থানে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে পৌঁছাতে অসুবিধায় পড়বে। এই বিশ্বাসের করণে প্রাচীন মিশরীয় সৈন্যরা বাইরের দেশে অভিযান পরিচালনার সময় উদ্বিগ্ন থাকত।
তাদের উদ্বেগ দূর করতে বাইরের দেশে অভিযানে নিহত সৈন্যদের মৃতদেহ মিশরে এনে সমাধিস্থ করার বিধান করা হয়েছিল। নারীদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার কোনো প্রমাণ নেই। প্রাচীন মিশরীয়দের রহস্যময় জীবনযাপন সম্পর্কিত আরো তথ্য থাকছে পরের পর্বে। এজন্য ডেইলি বাংলাদেশের সঙ্গেই থাকুন।