267805

ক্ষুদ্র এক অস্ত্র দিয়ে বিশালাকার প্রাণী শিকার করত এই প্রাচীন জাতি

ক্লোভিস সংস্কৃতি প্রাগৈতিহাসিক প্যালিয়ামেরিকান সংস্কৃতি। ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে নিউ মেস্কিকোর ক্লোভিসের নিকটবর্তী একটি স্থান থেকে প্লাইস্টোসিন প্রাণীকূলের দেহাবশেষের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রস্তর সরঞ্জাম পাওয়া যায়।

সে কারণেই প্রাচীন নিদর্শন পাওয়ার স্থানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ক্লোভিস সংস্কৃতি। যায়, তুষার যুগের শেষের দিকে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বছর আগে বর্তমান ছিল এই সংস্কৃতি।

ক্লোভিস সংস্কৃতির বর্ণনা 

ক্লোভিস সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এর আকার। পাথরের বরশী বিন্দু যা ক্লোভিস পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। ক্লোভিস পয়েন্ট দ্বিমুখী বরশী। যা উভয় পাশেই বাঁধা হতো। এই নিদর্শনগুলোর ব্যাপক উপস্থিতি কোনো একক জনগোষ্ঠী বা একাধিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দ্বারা সৃষ্টি কিনা সে বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা একমত নন। ক্লোভিসরা সাধারণত ম্যামথ, বিলুপ্ত বিসন, টাপির, ঘোড়া এবং অন্যান্য ছোট ছোট প্রাণী শিকার করত। তাদের ১২৫ টিরও বেশি উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল।

ক্লোভিস নারী ও পুরুষ

ক্লোভিস নারী ও পুরুষ

ক্লোভিস সংস্কৃতির আবিষ্কার

১৯০৮ সালে জর্জ ম্যাক জুনকিন নামে একজন রাখাল বালক একটি প্রাচীন বিসোনের কঙ্কাল খুঁজে পান। এরপর স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। হ্যারল্ড কুক এবং জেসি ফিগিন্সের নেতৃত্বে ১৯২৬ সালে নিউ মেক্সিকোর ফলসোমের নিকটের এই প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট প্রথম খনন করা হয়।

১৯২৭ সালে তারা ২৯ আগস্ট তারা প্রাচীন মানুষের দেহাবশেষের সন্ধান পায়। প্লাইস্টোসিন চলাকালীন আমেরিকাতে মানুষের উপস্থিতির এই নিশ্চয়তা অনেক গবেষকদের প্রাচীন মানুষের সন্ধান করতে অনুপ্রাণিত করে। ১৯২৯ সালে ১৯ বছর রিজলি হোয়াইটম্যান পূর্ব নিউ মেক্সিকোর ব্ল্যাকওয়াটার ড্রয়ের নিকটে অবস্থিত ক্লোভিস সাইটটি আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানে ম্যামথের দেহাবশেষ, ফ্লুটেড পয়েন্টের সন্ধান পেয়েছিলেন।

ক্লোভিস সাইট থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন

ক্লোভিস সাইট থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন

তার আবিষ্কার প্রথমে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি। এরপর নিউ মেক্সিকো হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট একই অঞ্চলে প্রাচীন দেহাবশেষের স্তুপ খুঁজে পায়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই আবিষ্কারের পরে ক্লোভিসে খনন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেখানে বরশীর অগ্রভাগ, আগুন জ্বালানোর স্থান, পাথরের বিভিন্ন জিনিসপত্রের সন্ধান মেলে। গবেষকরা এখানে প্রায় ১৩ হাজার বছর পূর্বের মানুষের অস্তিত্ব পেয়েছেন, যা মানব ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষ শিকারি

ক্লোভিস সংস্কৃতি সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই অজানা। তবে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায়, তারা দক্ষ শিকারি ছিল। ক্লোভিসদের শিকারের দক্ষতার কথা শুনলে এখনো অবাক হতে হয়। ম্যামথ, বড় কচ্ছপ, উট এবং বাঘ প্রভৃতি প্রাণী শিকারে তারা দক্ষ ছিল। নিউ মেক্সিকোর ক্লোভিসে মূল প্রত্নতাত্ত্বিক এই সাইটটি অবস্থিত। সেখান থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে জানা যায়, অতীতে ওই অঞ্চলে এসব প্রাণীই শিকার করা হত।

বিশালাকার প্রাণী তারা ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়েই শিকার করত

বিশালাকার প্রাণী তারা ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়েই শিকার করত

ক্লোভিস পয়েন্ট 

ক্লোভিস পয়েন্ট হলো নিউ ওয়ার্ল্ড ক্লোভিস সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট বাঁশিযুক্ত প্রক্ষেপণ পয়েন্ট। ক্লোভিস পয়েন্ট সমান লেকেসোলেট বা পাতা-আকৃতির বস্তু। সামান্য উত্তল পক্ষের সমান্তরাল এবং অবতল ঘাঁটিগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকত। এগুলো বর্শার অগ্রভাগে যুক্ত করা হতো শিকারের জন্য।

এর একদিকে সংযুক্ত করার স্থান থাকত এবং অন্য সব দিক ছিল ধারালো। এগুলোর দৈর্ঘ্য চার থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হত। আর প্রস্থ থাকত প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। কাঠ কিংবা হাড়ের গ্রভাগে এই ধারল বস্তুর মাথা ঢুকিয়ে শিকারের কাজে ব্যবহৃত হত। যা খুবই কার্যকর হাতিয়ার ছিল। এগুলোই ক্লোভিস পয়েন্ট নামে পরিচিত।

ক্লোভিস অঞ্চলের মানচিত্র

ক্লোভিস অঞ্চলের মানচিত্র

ক্লোভিসদের আগমন এবং বসতি স্থাপনের সময়কাল

আমেরিকার প্রথম অধিবাসীরা ক্লোভিস সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। এরা প্যালেওইন্ডিয়ান বা প্রাচীন ইন্ডিয়ান। তারা উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার আদি অধিবাসী। জানা যায়, উত্তর রাশিয়ার বিশেষত সাইবেরিয়া অঞ্চলের মানব গোষ্ঠীর উত্তরসূরী ক্লোভিসরা। কৃষিকাজের মাধ্যমে ফসল ফলানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের পূর্বে শিকারই ছিল খাদ্য সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম।

ধারণা করা হয়, তুষার যুগের শেষ দিকে তারা বেরিং প্রণালীর আশেপাশের সমুদ্র অঞ্চলের পানি জমাট বাঁধা অবস্থায় আলাস্কায় প্রবেশ করেছিল। পরবর্তীতে তারা সমগ্র আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ক্লোভিস থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনের গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বছর পূর্বে আমেরিকা মহাদেশে তাদের বিচরণ ছিল। তবে ক্লোভিস অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিকার এবং খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। আর এ কারণেই ক্লোভিস অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত ঘটতে থাকে বলে গবেষকদের ধারণা। এখনো এই অজানা সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে গবেষণা চলছে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.