238656

চোর ভেবে শজারুর ওপর হামলা, ৩ দিন পর মৃত্যু

অনলাইন সংস্করণঃ- সোমবার সাতক্ষীরার ট্যাংরাখালী ক্যাম্প এলাকায় চোর ভেবে এক শজারুর ওপর হামলা চালিয়েছিল গ্রামবাসী। পরে তাকে উদ্ধার করে শ্যামনগর উপজেলা পশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসায় ওই সজারু ভালো হয়ে উঠলেও বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু ঘটে।

বন্যপ্রাণী রক্ষায় নিয়োজিত ঋজু আজম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি জানান, ‘আহত সেই শজারুটি সকালে মারা গেছে। কিছুক্ষণ আগেই শজারুটিকে স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে ফরেস্ট ক্যাম্প প্রাঙ্গণে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। মাথায় আঘাত পাওয়ায় গুরুতর আহত শজারুটি বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছিল। ফরেস্ট ক্যাম্পের লোকজন গত কয়দিন থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে শজারুটির চিকিৎসা ও সেবা করেছেন। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচান গেল না।’

এর আগে সোমবার ঋজু আজম তার ফেসবুকে লেখেন-

‘আজ (সোমবার) খুব সকালে ঘুম ভাংলো মোবাইলের রিং টোনে। অচেনা এক নম্বর থেকে এক লোক জানালেন যথিন্দ্রনগর এলাকায় একটি শজারু ধরা পড়েছে। ঘটনাস্থল পার্শেখালী ব্রিজ থেকে ডানে। অর্থাৎ আমার অফিস থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটারের পথ। সাথে সাথে জানিয়ে দিলাম আমি আসছি। সহপাঠী মোস্তফা ভাইকে নিয়ে মোটরসাইকেলে রওনা হলাম। পথে ফোনে টেংরাখালী বন টহল ফাঁড়ি ও ভিটিআরটি সদস্যদের ঘটনা জানালাম।

পার্শেখালী ব্রিজ থেকে ডানে সামান্য যেতেই দেখলাম এক বাড়ীর সামনে উৎসুক মানুষের জটলা। কাছে যেতেই চোখে পরল একটি পূর্ণবয়স্ক শজারু আহত অবস্থায় সাদা বস্তার উপর রাখা হয়েছে। মাথার কাছে এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢাকা ও পায়ে রশি বাঁধা। কোনো রকম শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে। মাথার কাছে রাখা কাপড় তুলে দেখলাম আঘাত গুরুতর। মাথায় গভীর ক্ষত। অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। নাকমুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা? উপস্থিত লোকজন বলল শুধু মাথায় আঘাত লেগেছে। ততক্ষণে বন বিভাগের লোকজন ও ভিটিআরটি, সিপিজি সদস্যরাও চলে এসেছে। বন বিভাগের নির্দেশ মতো গুরুতর আহত শজারুটি টেংরাখালী ক্যাম্পে আনা হল। প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিলো হয়তো সজারুটি বেশীক্ষণ বাঁচবে না। কিছুক্ষণ পরেই শজারুর সামান্য নড়াচড়া লক্ষ করলাম। মনে আশার সঞ্চার হল। সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ ফরেস্টের এসিএফ মোঃ রফিক স্যারের নির্দেশে টেংরাখালী ক্যাম্পের বোরহান খান ভাই, মোস্তফা ও আমি আহত শজারুটিকে একটি সুবিধাজনক বক্সে নিয়ে মোটরসাইকেলে ছুটলাম; প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের শ্যামনগর উপজেলা পশু হাঁসপাতালে। বৃষ্টি, ভাঙ্গাচোরা পিচ্ছিল গ্রামীণ পথে মোটরসাইকেল চালানো কঠিন। তবে আমাদের মোস্তফা ভাই মোটরসাইকেল চালাতে বেশ দক্ষ।
উপজেলা পশু হাঁসপাতালে ডাক্তার ক্ষত ও শজারুর সঙ্গিন অবস্থা দেখে বললেন, চেষ্টা করছি কিন্তু বাঁচবে কিনা বলা কঠিন। পশু হাঁসপাতালে সচারচর বন্যপ্রাণী নিয়ে কেউ আসেনা। উপজেলা পশু হাঁসপাতালে ডাক্তার প্রায় সবাই খুবি আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসা শুরু করলেন। ক্ষত পরিষ্কার করার সময় ক্ষত থেকে মাথার খুলীর হাড়ের তিনটি টুকরো বেরিয়ে এলো। শজারুর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। সমস্ত শরীর যেন শিউড়ে উঠছিল। ডাক্তার ক্ষত পরিষ্কার করে তাতে সেলাই করে দিল। দুটি ইনজেকশন দেওয়া হল। আরও কিছু ইনজেকশন ও ঔষধ লিখে দিলেন। ডাক্তার বলে দিলেন, প্রাণীটি এখনো আশঙ্কা মুক্ত নয়। চেষ্টা করেছি বাকিটা আল্লাহ্‌ ভরসা।

শ্যামনগর উপজেলা পশু হাঁসপাতালের চিকিৎসা শেষে শজারুটি টেংরাখালী ক্যাম্পে নিয়ে আসলাম। এখন ক্যাম্পেই আছে। ক্যাম্পে রেখেই পরবর্তী চিকিৎসা ও সেবা চলছে। ক্যাম্পের বোরহান খান ভাই প্রাণীটির ব্যাপারে খুব আন্তরিক দেখেছি। উনাকে বলেছি, যখনি প্রয়োজন হয় জানাবেন; আমি চলে আসবো।

খুব সকালে বেরিয়ে কিছুক্ষণ আগেই ফিরলাম। পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়লে ভিটিআরটি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার ভাই তার বাড়ীতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। অফিসে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। আগামীকাল (মঙ্গলবার) সকালে শজারুটিকে দেখতে যাব। আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি গুরুতর আহত শজারুটিকে বাঁচাতে। সবাই দোয়া করবেন যেন শজারুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।

পরে ঘটনার বিবরণে জানলাম, গভীর রাতে চোর সন্দেহে লোকজন বের হলে বাড়ীর পিছনের ঝোপঝাড়ে লোকজন অদ্ভুত গড়নের এই প্রাণীটি দেখতে পায়। (বলেরাখা ভালো, সাতক্ষীরা রেঞ্জ সুন্দরবনে শজারু খুব বিরল। সাতক্ষীরা বনাঞ্চলের স্থানীয় বনজীবীরা পর্যন্ত কেউ এই শজারু বনে দেখেনি। তবে আমরা বনে গবেষণার কাজের সময় একবার দেখেছিলাম। নিশাচর প্রাণী হওয়ায় সাধারণত্ব দিনের বেলায় শজারু দেখা যায়না)। অচেনা প্রাণী দেখে অতি উৎসুক লোকজন ধাওয়া করে চিংড়ী ঘেরের পানিতে ফেলে প্রাণীটিকে আহত করে। তাৎক্ষণিক কিছু মানুষ সেই প্রাণীটিকে রক্ষ্যায় অতি-উৎসুকদের বাঁধা দিয়ে প্রাণীটিকে পানি থেকে তোলে। সেই গভীর রাতে কে বা কারা এই নিরীহ প্রাণীটিকে এমন জঘন্য ভাবে আহত করেছে তা জানা কঠিন। তবে ধন্যবাদ সেই একই এলাকার লোকজনদের যে, তারা শজারুটিকে পানি থেকে তুলে আমাদের খবর দিয়েছেন। নয়তো সেই পানিতেই আহত শজারু মরে পড়ে থাকতো। কেউ হয়তো খবরও পেতাম না। এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর যে, সুন্দরবন সংলগ্ন বসতীর লোকজন দিনে দিনে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সচেতন হয়ে উঠচ্ছে। তা হয়তো সুন্দরবনে বর্তমান বাঘের অবস্থার প্রকাশিত ফলাফল থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব। তবে সকল যুগে ও স্থানে কিছু দুষ্কৃতিকারী থাকেই। তাদের জন্য ভালো কাজ হয়তো কদাচিৎ ব্যাহত হয় কিন্তু থেমে থাকেনা।

ধন্যবাদ-

ছবি ও লেখা- ঋজু আজম, ওয়াইল্ডটিম, সুন্দরবন, সাতক্ষীরা ফিল্ড অফিস।’

[বানান ও ভাষা একই রাখা হয়েছে।]

 

সূত্র দেশ রূপান্তরঃ

পাঠকের মতামত

Comments are closed.