238455

ভারতীয়দের তীব্র প্রতিবাদে ‘বাংলাদেশকে চিবিয়ে খাব’ বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার!

অনলাইন সংস্করণঃ- বিশ্বকাপ এলে তো স্টার স্পোর্টস বিতর্কিত বিজ্ঞাপন তৈরি করবে- এটা নিয়ম হয়ে গেছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে উপলক্ষ্য করে বহু পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ব্যবহার করা এবং বাংলাদেশকে কটাক্ষ করায় ভারতীয় বাঙালিদের প্রতিবাদের মুখে সেই বিজ্ঞাপন তুলে নেওয়ার ঘটনা বিরল। কিন্তু এবার সেই ঘটনাই ঘটিয়ে দিলেন ভারতের বাঙালিরা।

ভারত-বাংলাদেশের ম্যাচের ঠিক আগে ভারতের শীর্ষ কম্পানি ডাবরের একটি দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনে বাঙালি সংস্কৃতিকে আঘাত করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় ওই টিভি বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছে ডাবর। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ডাবর ধারাবাহিকভাবে তাদের টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। পাকিস্তান, ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ভারতের ম্যাচের ঠিক আগেই সেগুলো দেখানো শুরু করেছিল।

এর ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবারের ভারত বাংলাদেশ ম্যাচের আগ দিয়ে ওই সিরিজের নতুন বিজ্ঞাপনটি দেখানো শুরু হয়। সেখানে অভিনেতা মনোজ পাওয়াকে দেখা যাচ্ছে এক বাটি ভর্তি তিলের নাড়ু খেতে, যেটাকে তিনি বর্ণনা করছেন ‘বাংলাদেশ থেকে আনা তিলের নাড়ু’ বলে। বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যাচ্ছে তিনি একেকটা নাড়ু খাচ্ছেন আর বলছেন, ‘আমি যেভাবে তোমাদের তিলের নাড়ু চিবোচ্ছি, ওখানে আমাদের এগারোজন মিলে ধুয়ে দেবে ওদের।’

বিজ্ঞাপনটির একেবারে শেষে শরীর নাচিয়ে ব্যাঙ্গ করে তিনি বলছেন, ‘কী ধুয়ে দিল তো? টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে….’। টিভি চ্যানেলগুলিতে এই বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু হতেই সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু করেন ভারতীয় বাঙালিরা। বলা হয়, তিলের নাড়ু তো শুধু বাংলাদেশের মিষ্টি নয়, ভারতের বাঙালিরাও পছন্দ করেন। সেটাকে ব্যঙ্গ করার অর্থ সব বাঙালিদেরই অপমান করা। এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা জুড়ে দেওয়ার সময়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা কী এটা মনে রাখেন নি যে তিনি দুটি দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন!

শোয়েব দানিয়াল নামের এক টুইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘এই বিজ্ঞাপনে একটা সত্যকেই অস্বীকার করা হয়েছে যে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো শুধুই বাংলাদেশের নয়, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গেরও অঙ্গ।”

বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি স্বপক্ষে ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার চালান অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জী। তিনি এবং তার সঙ্গীরা মিলে যে ‘বাংলাপক্ষ’ নামের সংগঠন তৈরি করেছেন, তারাই প্রথম প্রতিবাদ শুরু করেন ফেসবুকেই। গর্গ চ্যাটার্জী লিখেছিলেন, ‘তিলের নাড়ু ও টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে যাদের, তাদের চিবিয়ে খাবে বলে বাঙালি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে ডাবর কম্পানি। রুখে দাঁড়াও।’

তাকে ট্যাগ করে সুজয় দত্ত নামে একজন লিখেছেন, ‘এতদিন বাংলায় কথা বললে বাংলাদেশি তকমা দিত হিন্দুস্তানের মানুষরা, আর এবার একদম আরও দুই পা বাড়িয়ে বাংলাদেশি ট্যাগলাইন মেরে বাংলা সংস্কৃতির বুকে তীর মারলো ডাবর কম্পানি। জানি না আর কী কী দেখতে হবে! এজন্য লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে ডাবরকে।’

চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখার্জীর টুইটের ভাষা ছিল যথেষ্ট কড়া। তিনি লিখেছেন, ‘সেলুলার জেলে (আন্দামানের) গিয়ে নামের তালিকায় চোখ বোলাও। দেখতে পাবে টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে বলা অনেক ছেলের নাম আছে। ফাঁসির আগে তাদের অনেকেরই শেষ ইচ্ছা থাকতো মায়ের হাতে বানানো তিলের নাড়ু খাওয়ার। যাতে তিলের নাড়ু খেয়ে গলায় ফাঁসির দড়ি পড়ার ৮০ বছর পর তোমরা এরকম একটা নিম্নমানের, হাস্যরসবিহীন, কুরুচির বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পার ভণ্ড জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে! এরপর তোমরা টয়লেট ক্লিনার তৈরিতে মন দাও, ওটাই তোমাদের জায়গা।’

শৌকার্য ঘোষাল নামে একজন নিজেকে ‘তিলের নাড়ুর বড় ভক্ত’ বলে জানিয়ে ফেসবুকে একটি বড় পোস্ট করেছেন। সেখানেই তিনি লিখেছেন, ‘যে জাতীয় সঙ্গীত খুব জাতীয়তাবাদী ভাব দিয়ে তোমরা গাও, সেটাও কিন্তু সেই একই ব্যক্তির লেখা, যিনি টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে লিখেছিলেন।’

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই #বয়কটডাবর হ্যাশট্যাগ তৈরি হয়ে যায়। সাংবাদিক সৌম্যজিত মজুমদার টুইটারে লেখেন, ‘বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে ডাবরের এই বিজ্ঞাপনটি সম্পূর্ণভাবে জাতিবিদ্বেষী। এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত সহ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিটা অঙ্গকে অপমান করেছে।’

প্রসেনজিত চক্রবর্তীর টুইটারে লিখেন, ‘ডাবর কী আদৌ জানে যে তারা যে লাইনটা ব্যবহার করেছে, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা? যিনি আমাদেরও জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা.. আর ১১ কোটিরও বেশি বাঙালি অন্য সকলের মতোই ভারতীয় বলে গর্ব করে। হিন্দির পরে এই ভাষাতেই সবথেকে বেশি মানুষ কথা বলে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন নিয়ে মস্করা করার সাহস হয় কী করে?’

প্রতিবাদ যে শুধু ভারতের বাঙালিরা করেছেন, তা নয়। শোয়েব দানিয়াল নামের এক টুইট ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘এই বিজ্ঞাপনে একটা সত্যকেই অস্বীকার করা হয়েছে যে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো শুধুই বাংলাদেশের নয়, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গেরও অঙ্গ।’

সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদ হতে থাকায় ডাবর একটি টুইট করে বিজ্ঞাপনটি তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ঘটনাচক্রে, ডাবর সংস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল কলকাতাতেই। তার মূল মালিক ছিলেন ডাক্তার এস কে বর্মণ। ডাক্তার বর্মণ নাম দুটির অদ্যাক্ষর দিয়েই ডাবর কোম্পানির নাম।

একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন ব্যঙ্গ করে বলার জন্য প্রতিবাদ হয়েছে, তেমনই বাংলাদেশকে চিবিয়ে খাবার ইঙ্গিত দিয়েও জাতিবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগও অনেকেই তুলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদ হতে থাকায় ডাবর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি টুইট করে বিজ্ঞাপনটি তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে কারও ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্য ক্ষমাও চায়। ডাবরের দাবি, তারা একটু মজা করতে চেয়েছিল!

 

সূত্র কালেরকণ্ঠঃ

পাঠকের মতামত

Comments are closed.