232095

‘পেটোত ভাত নাই আর ঈদ’

দেশের এক কোটি কৃষক পরিবারে এবার কোনো ঈদ নেই। পত্রিকার মফস্বল পাতা এবং টেলিভিশনে জনপদের খবর যারা লক্ষ করেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন কী করুণ-কাতর কণ্ঠে কৃষক ভাইরা বলছেন তিন মণ ধান বিক্রি করেও সন্তানের একটি জামার দাম উঠছে না। একজন কৃষাণীকে দেখলাম কোলের ওপর ধান বিছিয়ে আকুল নয়নে কেঁদে বলছেন- ঈদ এবার হবার নয় বাহে।

কৃষক যখন বলছেন ‘ঈদ এবার হবার নয়’, তবে তো কারো জন্যই ঈদ হওয়ার কথা নয়। কারণ নেতারা তো সারাক্ষণ বলেই চলেছেন- কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষকের তো ঈদ হচ্ছে না, কিন্তু দেশে কি ঈদ আয়োজনে কোনো কমতি আছে? দেদার বিক্রি হচ্ছে লাখ লাখ টাকা মূল্যে গারারা, সারারা ও লাখেœৗ স্টিচের পাঞ্জাবি। ঈদ উদযাপনের জন্য বিদেশ যাচ্ছেন ছয় লাখ বাংলাদেশি। ঈদকে উপলক্ষ করে বিমান ভাড়া বাড়ানো সত্ত্বেও আরও কয়েক লাখ হাহাকার করছেন এই বাড়তি ভাড়ার টিকিটের জন্যই।

পয়সা কোনো ব্যাপার নয় তাদের কাছে, দরকার বিলাস ভ্রমণ। বিমান কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে- দুবাই, কাতার, মাসকাট, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও কলকাতা রুটে যাত্রীর চাপ অত্যধিক বেশি। চড়া দামের আকাশপথের টিকিট নিয়ে চলছে রীতিমতো কাড়াকাড়ি। এয়ার লাইনসগুলো শতাধিক অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেও বিত্তবান ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের চাপ সামলাতে পারছে না। বাহ্, খুবই ভালো। এই বৈষম্যের বাংলাদেশের জন্যই তো ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল! দুই বিমান ভাড়া যতই বাড়ানো হোক, পোশাকের মূল্যও যত অযৌক্তিক পরিমাণে বেশি হোক, কোনো শ্রেণির ভোক্তাদের কোনো অসুবিধা নেই এসবে? বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তা আমাদের বৈদেশিক আয় ও বিনিয়োগের চেয়েও বেশি।

দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন আছে। কীভাবে তার প্রয়োগ হয় আমরা তা জানি না। সরকারের ইচ্ছায় একের পর এক ব্যাংকের লাইসেন্স ইস্যু করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১০ শতাংশ পুঁজি দিয়ে শতভাগ ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে মালিকপক্ষ (৯০ শতাংশ পুঁজির জোগান দিয়েও আমানতকারীদের কোনো ক্ষমতা নেই)। তারা, তাদের পছন্দমতো ব্যক্তি ও সংস্থাকে ঋণ দিচ্ছেন। পছন্দের মানুষকে ঋণ দিয়ে দিয়ে সরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। না, ‘মাদারিকা খেল’-এর এখানেই শেষ নয়। মূলধন ঘাটতির কারণে যেসব ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের মূলধন ঘাটতি এবং সুদ ভর্তুকি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আগামী বাজেটে সরকারের কাছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। কোনো নিয়মনীতি না মেনে পছন্দের লোককে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে যারা ফাঁকা করে দিয়েছে, তাদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা আছে কিন্তু রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে কাঁদা মাখিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে যে কৃষক ভাই ১৭ কোটি মানুষের মুখে খাবার জুগিয়ে যাচ্ছেন তার জন্য কোনো ভর্তুকি নেই, কোনো শস্য বীমা নেই, সরাসরি কোনো অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা নেই, ঝুঁকির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কোনো প্রক্রিয়া নেই।

কৃষকের জন্য শস্যাগার নেই। সরকার কি জানত না, কৃষকের ধান রাখার জায়গা নেই? তার পরও ঠিকমতো শুকায়নি বলে তখন ধান ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন? আর এখন সরকার বলছে, ধান মাড়াই থেকে শুরু করে চাষাবাদের যাবতীয় কাজের জন্য মেশিন কিনতে প্রণোদনা দেওয়া হবে। যখন মেশিন কেনার প্রণোদনা দেওয়া হবে, তখন দেখা যাবে কিন্তু এখন কৃষক ধান নিয়ে যে পরিমাণ বিপাকে পড়েছেন তার কী হবে? যে দেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ করে, যে দেশ বালিশ প্রস্তুত ও উত্তোলন খরচে বিশ্বে এক নম্বর, সেই দেশে কৃষকের ধান মজুদের জন্য স্টোর বানানোর অর্থের বরাদ্দ থাকে না কেন! নওগাঁর একজন কৃষক সেখানকার সাংবাদিককে বলেছেন, ‘আশা ছিল ধান বিক্রি করে পরিবারে সবার জন্য ঈদের মধ্যে ভালো জামাকাপড় কিনব, কিন্তু তা আর হলো না। সেচ, সার, কীটনাশকওয়ালারা টাকার জন্য আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।’ শোধ করতে পারছেন না মহজনের ঋণ। এ অবস্থা দেশের এক কোটি কৃষক পরিবারে। ঈদ আনন্দ কৃষকের কাছে পরিণত হয়েছে ঈদ আতঙ্কে। তিন. এবার ঈদ তবে কাদের? কৃষকের এই বুক ফাটা হাহাকারের মধ্যেও ক্ষমতাবান শ্রেণির মধ্যে কিন্তু ঈদের আনন্দের কমতি দেখছি না। রূপপুর প্রকল্পের মতো আরও যেসব মেগা প্রকল্প চলছে, সেই সব প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জমকালো ঈদ উৎসব পালন করবেন আশা করি। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণ ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা যাদের জন্য করা হয়েছে, আশা করি তারাও জমজমাট ঈদ পালন করবেন।

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যারা ৯০০ কোটি টাকা অর্থ পাচার করছেন, সন্দেহ নেই তারাও ভালো ঈদ করবেন। টরেন্টোয় বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম নির্মাতাদের ঈদও কি কম জৌলুসপূর্ণ হবে? ঈদ উদযাপনকারীদের তালিকা নেহাত ছোট নয়। দুর্নীতিবাজ আমলা, পুঁজি লুটেরা ব্যবসায়ী, খাল-বিল-নদী এবং ভূমি দখলকারী রাজনীতিক, পুঁজি পাচারকারী, ঋণখেলাপি, আদম বেপারিদের ঈদ খারাপ যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। এক বুটিক শপের স্বত্বাধিকারী বলেছেন, গুলশান-বনানীর ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক সময় খরচা করে শতভাগ আনকমন থিম বেছে নিয়ে পোশাকের ডিজাইন করেছেন তিনি। এই প্রথম জানলাম পোশাকের ডিজাইনের চিন্তা করার সময় এলাকার কথাও মাথায় রাখতে হয়। পরের বছর হয়তো শুনব নির্দিষ্ট কোনো প্যালেসের কথা মাথায় রেখে পোশাকের ডিজাইন করা হচ্ছে। শিক্ষার আসলে কোনো শেষ নেই ! চার এই সেই দেশ যেখানে কস্টিউম, জুয়েলারি, ওয়ালেট কিংবা তারও চেয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসপত্র কেনার জন্য ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর চলে যান একটি শ্রেণি। আর কাজ না পেয়ে কর্মসংস্থানের আশায় ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরের বরফ পানিতে অহরহ ডুবে মরে আমাদের ভাইয়েরা। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়েনি। বণ্টন ও বৈষম্য নিরসনের কোনো ব্যবস্থাও নেই।

ঋণখেলাপি, করখেলাপির বিরূদ্ধে যে আইন আছে তার প্রয়োগও নেই। ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের শাস্তি দেওয়ার বদলে উল্টো আরও টাকা এবং প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম পন্থায় ধনী হওয়ার এই বাংলাদেশে পানিতে ডুবে ভেসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যে শ্রমিক ভাইয়েরা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। পাটকল শ্রমিক ভাইয়েরা প্রাপ্য বকেয়া বেতন পাননি। গার্মেন্ট শ্রমিক ভাইবোনদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে। বেতন-বোনাস চাইতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে এসছেন- এমন ঘটনা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অথচ ঈদ নাকি ধনী-গরিব সবার এক হয়ে একসঙ্গে আনন্দ করার দিন। শুনতে মন্দ নয় ! পাঁচ আমাদের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, এবার ঈদযাত্রা হবে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক। প্রায় একই দাবি রেল ও নৌমন্ত্রীরও। ইতোমধ্যে রেলওয়ের শিডিউল বিপর্যয় চরমে উঠেছে। কোনো ট্রেনই সময়মতো ছাড়ছে না, গন্তব্যেও পৌঁছাচ্ছে না। স্মরণকালের স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রার একটি নমুনা দেখা গেল টেলিভিশন চ্যানেলে।

১৯৬৩ সালের নিবন্ধনকৃৃত লঞ্চ ২০১৩ সালে নবায়ন দেখানো হয়েছে। লঞ্চের তলানি খুলে পড়ছে কিন্তু বাইরের রঙ চটকদার। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী কেন বহন করা হচ্ছে প্রশ্নের উত্তরে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রী কি গুনে গুনে তুলব নাকি? কী দেখে এসব লঞ্চকে যাত্রার অনুমোদন দেয় বিআইডব্লিউটিএ? ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীই বা কেমন করে নেয়? নজরদারির জন্য কি কেউ থাকবে না? নাকি কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছে এসব লঞ্চের যাত্রীরা গণ্যমান্য, গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। এরা ডুবলেই কী আর বাঁচলেই কী? এই হলো বৈষম্যহীন সোনার বাংলার নমুনা, যার সংবিধানে লেখা আছে জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। তো সেই ‘মালিক জনগণ’ এবার বলছে ‘পেটোত ভাত নাই আর ঈদ করিমো ক্যামনে বাহে?’ য় জয়া ফারহানা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

পাঠকের মতামত

Comments are closed.