229083

এই মোসাদ্দেকের যে গল্পটা হয়তো আপনারা জানেন না…

অনলাইন সংস্করণঃ- গত ১৭ মে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ঘটে গেছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ২২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার কোন শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৫ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছিল টাইগাররা। আর ওই ম্যাচের নায়ক ছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। বাংলাদেশকে শিরোপা পাইয়ে দেয়া

এই মোসাদ্দেক কিভাবে এ পর্যন্ত এলেন সেটা কি জানেন? মোসাদ্দেকের জীবনী নিয়ে লেখা বাংলা অনলাইন ম্যাগাজিন ‘এগিয়ে চলো’ থেকে আমাদের সময়.কম পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
ফাইনাল ম্যাচটা দেখছিলাম এক বন্ধুর বাসায়। মেস বাসা, হরেক রকম মানসিকতার লোকজন থাকে। মোসাদ্দেক যখন ব্যাটিংয়ে নেমেছেন, ম্যাচটা তখন বাংলাদেশের হাত থেকে অনেকটাই বেরিয়ে গেছে। জয়ের জন্যে ৫০ বলে প্রয়োজন ৭৭ রান, হাতে আছে মাত্র পাঁচটা উইকেট।

আর একজন ব্যাটসম্যান আউট হলেই বাংলাদেশ দলের লেজটা বেরিয়ে পড়ে। টেলিভিশনের সামনে দাঁড়ানো একজন মোসাদ্দেককে নামতে দেখেই মন্তব্য করলো- ‘*লটা ছিঁড়বে মোসাদ্দেক!’
পরের আধঘন্টায় মোসাদ্দেক কি করেছেন, ডাবলিনের ম্যালাহাইডে কি তাণ্ডবটা চালিয়েছে সেটা এখন সবাই জানে। মোসাদ্দেক, বা বাংলাদেশ দলের আরও অনেক খেলোয়াড়কে নিয়েই এরকম বিরূপ মন্তব্য করা হয় প্রতিনিয়ত। বাঙালি দর্শক চায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা প্রতি ওভারে অন্তত দুটো বাউন্ডারি হাঁকাবেন, বোলিংয়ে এলে ওভারপ্রতি অন্তত একটা উইকেট তো নিতেই হবে! নইলে সে আবার খেলোয়াড় হলো নাকি? আকাশ কুসুম এই চাহিদা প‚রণ করতে না পারলেই দাও গালি!

যাই হোক, মোসাদ্দেকে ফিরে যাই। মোসাদ্দেক ওইদিন ভালো খেলেছেন, তাকে নিয়ে এখন প্রশংসা হবেই। ভালো খেলতে না পারলে আজ যারা প্রশংসা করছে, তারাই তাকে শূলে চড়াতো। সমস্যা হচ্ছে, মিনিটে মিনিটে ভোল পাল্টানো গালিবাজ লোকগুলোর জানার কথা নয়, জাতীয় দলের জার্সিটা গায়ে জড়াতে কতটুকু পরিশ্রম করতে হয়েছে মোসাদ্দেককে। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত আজ যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছন, সেখানে আসতে কত কঠিন পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে, সেসব অনেকেই জানেন না।

মোসাদ্দেকের ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান যে মানুষটার, তিনি এখন বেঁচে নেই। মানুষটার নাম আবুল কাশেম, মোসাদ্দেকের বাবা তিনি। ভদ্রলোক জেলা ক্রীড়া সংস্থায় চাকরি করতেন। তার ভীষণ শখ ছিল, ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। নিজেই আগ্রহ সহকারে ছোট্ট মোসাদ্দেককে কে নিয়ে যেতেন মাঠে, কিনে দিতেন ব্যাট-প্যাড-জুতো।
কিন্ত হঠাৎই ঘটলো অঘটন, মোসাদ্দেক যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন মারা গেলেন বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটা নেই, তিন ছেলেকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়লেন মোসাদ্দেকের মা হোসনে আরা বেগম। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন বেশ খারাপ, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। মোসাদ্দেকও ভেবে নিয়েছিলেন, ক্রিকেটার হওয়াটা তার নিয়তিতে নেই, কোন একটা চাকুরিতে ঢুকে যেতে হবে তাকে, এরকমই মনস্থির করে নিয়েছিলেন।সেখান থেকে হোসনে আরা বেগমের সংগ্রামের শুরু। আপাদমস্তক গৃহিনী এই মহিলা স্বামীর মৃত্যুর আগে হয়তো সংসারের চাল-ডাল নিয়েই মাথা ঘামাতেন বেশি। কিন্ত সন্তানদের নিয়ে জলে ভেসে যাওয়ার উপক্রম যখন হলো, তখনই তিনি হয়ে উঠলেন লৌহমানবী। দেবী দূর্গার মতো দশটা হাত যেন চলে এলো তার শরীরে, সেগুলো দিয়ে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরলেন তিন ছেলেকে, আগলে রাখলেন সংসারটাকে। দই কাঠার ছোট্ট এক টুকরো জমি ছিল তার শেষ সম্বল, ছেলেদের ক্রিকেটার বানাবেন বলে সেটা বিক্রি করে দিলেন, বড় ছেলে মোসাদ্দেককে ভর্তি করলেন বিকেএসপিতে।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, এর আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে বরাবরই তিনি দারুণ কীর্তির নজির রেখেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সেটার কয়েকটা নমুনা দেখা গেছে। জাতীয় দলে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়, ঝামেলা পাকালো চোখের ইনফেকশন, সেটার কারণে বেশ কিছুদিন দলের বাইরে থাকতে হলো। এর মাঝে ব্যক্তিগত জীবনেও ঝড়-ঝাপটা এসেছে। সব পাশ কাটিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নির্বাচকদের পছন্দ হিসেবেই মোসাদ্দেক উঠেছেন বিশ্বকাপের বিমানে।
মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত এখন বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডে, গত শুক্রবার আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন দুর্দান্ত এক হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। পেছনে ফিরে তাকালে তার নজরে পড়ে এক মায়ের হার না মানা সংগ্রাম। জমি বিক্রি করে ছেলেদের বিকেএসপিতে ভর্তি করেছিলেন হোসনে আরা বেগম, স্বামীর স্বপ্নটা ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে দেননি তিনি। মোসাদ্দেকের ছোট দুই ভাইও এখন পেশাদার ক্রিকেটার, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেন তারা, স্বপ্ন দেখেন, বড় ভাইয়ের মতো তারাও একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াবেন।

আমরা গলাবাজী করি, গালিবাজী করি, এই মানুষগুলোর সংগ্রামের কথা না জেনেই আজেবাজে মন্তব্য করে ফেলি ইচ্ছেমতো, খেলোয়াড়দের বাবা-মা তুলে গালি দিয়ে দেই- গালি দিতে তো পয়সা লাগে না। মোসাদ্দেক বা হোসনে আরা বেগমদের কষ্টকর প্রহরগুলোর খোঁজ আমরা রাখি না, আমাদের যতো তৃপ্তি নিন্দা করায়!

 

সূত্র আমাদেরসময়.কমঃ

পাঠকের মতামত

Comments are closed.