227118

মৃত্যুর মিছিল ভূমধ্যসাগরে

অনলাইন সংস্করণঃ- লিবিয়ায় মাত্র কয়েক দিন, এরপর সাগর পেরোলেই ইতালি। সেখানে যা আয় হবে, অন্তত এক মাসেই দেশে বাড়ি করা যাবে—এমন প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কর্মী পাঠাচ্ছে দালালচক্র। অথচ লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার ওই পথটি (মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুট) আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) দৃষ্টিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ইতালিতে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন—এমন প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

গত শুক্রবার ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ৩৭ বাংলাদেশিও ওই পথেই ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেদিন বেঁচে যাওয়া ১৪ বাংলাদেশির অন্যতম বিলাল আহমেদ ইউরো নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর সহযাত্রীদের একে একে মর্মান্তিকভাবে ডুবে মরার বর্ণনা দিয়েছেন। ছোট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে তাঁদের তোলা হয়েছিল। ৭৬ আরোহীর মধ্যে ৬০ জনই সাগরে ডুবে মারা গেছে। তিউনিসিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেল বলেছে, তাদের নৌকায় উঠতে জনপ্রতি প্রায় এক লাখ টাকা করে দিতে হয়েছে।

আইওএমের এক পরিসংখ্যান মতে, এ বছরের শুরু থেকে ৮ মে পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী সাগরপথে ইউরোপে ঢুকেছে। এ সময়ের মধ্যে সাগরে নিখোঁজ হয়েছে অন্তত ৪৪৩ জন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অভিবাসনের যে ধারা দেখা গেছে, তাতে ইতালি অভিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

আইওএমসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, লিবিয়ায় নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে সেখান থেকে কতজন ইউরোপের উদ্দেশে রওনা করছে আর কতজনই বা পৌঁছতে পারছে, তা অনুমান করা কঠিন। আন্তর্জাতিক জলসীমায় নৌকাডুবির অনেক ঘটনাই জানা যায় না। তিউনিসিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জারজিসে রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মোনজি স্লিম এএফপিকে বলেন, গত শুক্রবার যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের যদি তিউনিসিয়ার জেলেরা না দেখত, তাহলে হয়তো তারা সাগরে ডুবেই মরত। কেউ ওই নৌকাডুবির বিষয়ে জানতেই পারত না।

লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, তিউনিসিয়ায় ১৪ বাংলাদেশি উদ্ধার ও বেশ কয়েকজন নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার খবর জানতে পেরে দূতাবাসের কর্মীরা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সব ঠিক থাকলে আজ সোমবার তাঁদের তিউনিসিয়ায় পৌঁছার কথা। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশে পাঠানো দূতাবাসের কাছে অগ্রাধিকার।

এদিকে তিউনিসিয়ার জলসীমায় নৌকাডুবির রেশ কাটতে না কাটতেই ইউরোপীয় দেশ মাল্টার কোস্ট গার্ড অভিবাসনপ্রত্যাশী বোঝাই একটি নৌকা উদ্ধার করেছে। লিবিয়া থেকে ইউরোপন অভিমুখে যাত্রা করা ওই নৌকায় ৮৫ অভিবাসনপ্রত্যাশীর বেশির ভাগই বাংলাদেশ ও মরক্কোর নাগরিক বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক বিশেষ দূত ভিনসেন্ট কোচটেল। তিনি ওই ঘটনায় লিবিয়ায় কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই অন্য দেশে স্থানান্তর নয়, বরং নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান হবে।

লিবিয়া থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, রাজধানী ত্রিপোলির নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের সমর্থনপুষ্ট ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের সঙ্গে হাফতার বাহিনীর লড়াইয়ে এরই মধ্যে নিহত হয়েছে দুই শর বেশি লোক। ত্রিপোলিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অনেকে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। চরম সংঘাতময় ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে যখন অনেক দেশ তাদের দূতাবাস কার্যক্রম আশপাশের কোনো দেশে সরিয়ে নিয়েছে তখনো বাংলাদেশ দূতাবাস সচল রয়েছে। ভবিষ্যতে শ্রমবাজার খোলা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার পাশাপাশি বর্তমানে সেখানে অবস্থানরত কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েই বড় উদ্বেগ রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগেই লিবিয়ায় নতুন করে কর্মী যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও নানা পথ ঘুরে লিবিয়ায় যাওয়া অব্যাহত আছে। আর লিবিয়ায় সংঘাতের কারণে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন দালালচক্র বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের লোকজনকে ইউরোপে পাঠানোর জন্য নৌকায় তুলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, লিবিয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে। গৃহযুদ্ধ চলায় দেশটিতে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের চলাফেরার সুযোগও সীমিত। এর পরও প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে নতুন করে লিবিয়ায় গিয়ে কর্মীরা ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দালালদের প্রলোভনে পা দিয়েছিলেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার দুই সন্তানের জনক নুরুল ইসলাম। কিন্তু ইউরোপ যাওয়া হয়নি তাঁর। সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে অনেকের মৃত্যুর কথা শুনে লিবিয়া থেকে জীবনটুকু হাতে নিয়ে দেশে ফেরত এসেছিলেন তিনি। নুরুল ইসলাম এখন আশুলিয়ার জিরাবোতে মনিহারি সামগ্রীর ব্যবসা করছেন। দালালচক্র কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসীদের ইউরোপে নিতে প্রলুব্ধ করে এবং টাকার জন্য নির্যাতন চালায় সেসব কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন লাখ টাকায় ২০১৭ সালে ফ্রি ভিসার নামে গিয়েছিলাম কাতার। প্রতি মাসে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারব বলা হলেও সেখানে গিয়ে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করাই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কাতারে পরিচয় হয় বাগেরহাটের দালাল রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। রফিকুল প্রলোভন দেখিয়ে বলে, প্রতি মাসেই ইতালিতে উপার্জন করা যাবে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। ইতালি পৌঁছানোর পর দালালকে দিতে হবে সাত লাখ টাকা। উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ঝুঁকির মধ্যে কাতার থেকে তুরস্ক নিয়ে যায় দালাল। আমার সঙ্গী ছিল আরো ১৭ জন বাংলাদেশি। তুরস্কের একটি গুদামে নিয়ে আটকে রেখে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে দালাল সিন্ডিকেট। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা না দিলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে বাধ্য হয়ে গ্রামের জমি বিক্রি করে পরিবার টাকা দেয় দালাল সিন্ডিকেটের কাছে। তুরস্কে চার দিন রেখে নেওয়া হয় লিবিয়ার একটি উপকূলবর্তী জায়গায়। সেখানেও টাকার জন্য মারধর করতে থাকে আমাদের। এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে নির্যাতন থেকে রক্ষা পাই। আমরা ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আগের ট্রিপটি গিয়ে সমুদ্রে ডুবে যায়, অনেকেই মারা যায়। সেই ঘটনা শুনে আমি আর ইতালি না গিয়ে বাংলাদেশে ফেরত চলে আসি। কোনো প্রবাসী ভাই যেন লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপ না যায়। শত শত মানুষ মরছে, কোনো হিসাব নেই। আর রাস্তায় দালালরাই টাকার জন্য অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলে, কিছুই করার নেই।’

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের রফিক উল্যার ছেলে ফখরুল ইসলাম মুন্না ইতালি যাওয়ার পথে সাগরেই নৌকা ডুবে মারা যান। মুন্নার বোন সুরমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের সংসারের সুখ আনতে গিয়ে ভাইটিকেই আমরা হারালাম।’

তবে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ইতালি পৌঁছেছিলেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মোকসেদ আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম। বাংলাদেশ থেকে দালালচক্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা চুক্তিতে দুবাই ও তুরস্ক হয়ে সমুদ্রপথে পাড়ি দেন ইতালি। দুই বছরের মধ্যে গ্রামে নতুন বাড়ি বানানো এবং সংসারের অভাব দূর করতে পারলেও সমুদ্রপথে ইতালি যাত্রার সেই ভয় এখনো দূর হয়নি। আমিরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউরোপের কথা শুনে কারো কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছিলাম। কিন্তু দুবাইয়ের পর পথে পথে কতই না কষ্ট করতে হয়েছিল। কত দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসার সময় সাগরে পড়ে গিয়ে চার বাংলাদেশিকে মারা যেতে দেখেছি।’ আমিরুল ইসলামের মতো অনেকেই ইউরোপ যেতে পারলেও ইমরান মিয়া ও ফখরুল ইসলামের মতো শত শত যুবকের সমুদ্রেই প্রাণ গেছে। অনেকের লাশও পায়নি পরিবার।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন বেসরকারি সংস্থা ওয়ারবির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালালদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। দালালদের প্রলোভনের কারণেই ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার নামে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে আমাদের দেশের যুবকরা। এটা বাংলাদেশ থেকেও যেমন হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকেও হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা বেতনের মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে পাঠানো হয় ইতালি ও গ্রিসে। সমুদ্রপথে কত যে মায়ের বুক খালি হচ্ছে তার হিসাব নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘তিনটি চক্র এক হয়ে এটা করছে। মানবপাচারকারী, ড্রাগ বা গোল্ড স্মাগলার ও দালালরা মিলেই তাদের সিন্ডিকেট। জনপ্রতি ১০ লাখ টাকার বেশি নিয়ে তাদের ইউরোপে পাচার করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান) সৈয়দা সাহানা বারী বলেন, ‘লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপ যেন মানুষ এভাবে না যায়, সচেতনতামূলক কাজ করছি আমরা। মিডিয়ারও এ বিষয়ে বড় ধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত।

 

সূত্র কালেরকণ্ঠঃ

পাঠকের মতামত

Comments are closed.