226060

মানুষকে ভালোবাসলে খোদাকে পাওয়া যায়, এটিই ছিল শেখ সাদীর প্রধান উপদেশ (ভিডিও)

ডেস্ক রিপোর্ট : ফার্সি পদ্য ও গদ্যের জনক মহাকবি শেখ সাদি। প্রথম দিকে তিনি কিশোরদের জন্য উপদেশমূলক গল্প ও কবিতা লিখতেন। গল্পে গল্পে তিনি শুনিয়েছেন সততার পুরস্কার কীভাবে পাওয়া যায়। কীভাবে বিনীতশীলিত হতে হয়। কীভাবে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে হয়। এক কথায়, মানুষের সামগ্রিক বিকাশকে লক্ষ্য রেখেই তিনি গল্প, কবিতা রচনা করতেন। তা ছাড়া মানুষ হওয়ার বয়স কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই। এই বয়সে নিজের নৈতিক চরিত্র ঠিক রাখা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় শেখ সাদির রচনায়। তার লেখায় জ্ঞানী, গুণী মনীষীদের পবিত্র জীবনাচরণ উদাহরণ হয়েছে। আরবি কবিতা ও প্রবাদ বাক্য ছাড়াও তার লেখায় যথেষ্ট পরিমাণে পবিত্র কোরআন, হাদিসের উদ্ধৃতি লক্ষ করার মতো।

ইরানের আল-মুজতবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ শাখার মহিলা বিভাগের প্রধান শাহনাজ আরফিন বলেন, শেখ সাদির লেখা ‘কশিদা’ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। আমাদের এই উপমহাদেশে তার (বালাগাল উলা বিকামালেহি/কাশাফাদ দুজা বিজামালিহী/হাসুনাত জমিউ খিসালিহী/ছাল্লু আলাইহে ওয়া আলিহী) এই কাশিদাটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।

তার এই কাশিদার মাধ্যমে যেভাবে নবীজীর প্রতি দরুদ ও প্রেম প্রকাশ করা হয়েছে যা অন্য কোনো কবিতায় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

শাহনাজ আরফিন বলেন, শেখ সাদির পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সাদি সিরাজি। তিনি ইরানের সুপ্রসিদ্ধ ‘সিরাজ’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে দেশের রাজদরবারে সাদির বাবা চাকরি করতেন। সাদির বাবার নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম মাইমুরা খাতুন। কৈশরের আগেই কবির বাবা মারা যান। এ কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল অনেক কষ্টে। তার মা তাকে নিয়ে বড় কঠিন বিপদে পড়ে যান। শেষমেশ রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হয় তার নানার ওপর। কিন্তু নানার অবস্থাও সচ্ছল ছিল না। এদিকে স্বভাবকবি বলেই সাদির জ্ঞান, তৃষ্ণাও ছিল প্রবল। মা ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন ছেলেকে কীভাবে মানুষ করবেন। এতিম সাদিকে নিয়ে তার মা কতটা কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন।

ছোট্ট শেখ সাদি আর্থিক অনটনে স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কথাটিতে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। বাগদাদ নগরীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে শেখ সাদি একটি কবিতা লিখে বাগদাদের প্রধান বিদ্যালয়ের নিজামিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে দেন। সেই শিক্ষক তা পড়ে মুগ্ধ হয়ে শেখ সাদির মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সঙ্গে ধর্ম, দর্শন আর নীতিশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি মক্কায় হজ করতে যান। তার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য— তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে সময়ের পারস্য ছাড়াও তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আরব, মিসর, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমাংশ ভ্রমণ করেন।

আমলের বিজ্ঞ মন্ত্রী। তবে তার কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিলেন এই বাদশাহ যার নামকে তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। যদিও সে প্রশংসায় কোনো তোষামুদি কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তার রচিত ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থটিও বাদশার নামে উৎসর্গ করেছেন। বাদশার মৃত্যু হলে গুলিস্তাঁ থেকে দুটি মর্সিয়াও তার উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়।

শেখ সাদি রচিত একাধিক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘গুলিস্তাঁন ও বুস্তাঁন’ নামক গ্রন্থ দুটি অন্যতম। এই দুটি গ্রন্থ সম্পর্কে শাহনাজ আরফিন বলেন, দুটি গ্রন্থই বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত এই গ্রন্থ এখনো অমর হয়ে আছে বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারে। গ্রন্থ দুটি অনবদ্য পংক্তি সৃষ্টিতে যেমন সফল তেমনিভাবে সফল অভিভাকত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে। বর্তমানে আমাদের যুব সমাজে নানা ধরনের সন্ত্রাস, নীতিজ্ঞানের সংকট, মাদকাশক্তি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। চরিত্রহীনতার কার্যকলাপ বেড়েছে অবর্ণনীয়ভাবে। তথাকথিত উচ্চ শিক্ষা-দীক্ষায় জাতি আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও তাদের মাঝে অভাব রয়েছে নীতিগত বিদ্যাশিক্ষার। সুশিক্ষার অভাবে মানুষ অহরহ অন্যায় ও অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে।

জাতি স্বভাবত তার সাহিত্য শিক্ষার মাধ্যমে কৃষ্টি ও সভ্যতার জ্ঞান লাভ করে। আগেকার দিনে ব্রিটিশ দাসত্বের যুগেও মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা ছিল। ছেলেমেয়েরা নবী, আওলিয়াদের কেচ্ছা কাহিনী পড়ত এবং সে অনুযায়ী নিজেদের মন-মানসিকতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করত। শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁন ও বুস্তাঁন’ মূলত সেই নৈতিকতার শিক্ষা দিতে সক্ষম। এর উপদেশাবলি আমাদের জাতির জন্য এখনো পথ প্রদর্শক হয়ে আছে। শেখ সাদি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন নিষ্কলুষ চরিত্রের একজন কবি। তার বিনম্রতার পেছনে নিজামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকদের অবদান অসীম। ‘বুস্তাঁন’ গ্রন্থে অকপটে তিনি তা স্বীকার করেছেন। তার মতে, ফুলের সংস্পর্শে মাটির ঢেলা যেমনিভাবে সুগন্ধি প্রাপ্ত হয়, অনুরূপ জ্ঞানী-গুণীর সংস্পর্শে থাকলে মানুষের চরিত্রেও এ প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। ‘গুলিস্তাঁন’ গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘একদা গোসলখানায় এক মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে শুঁকে দেখলাম অফুরন্ত খুশবু, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আতরদানি, না সুবাসে ভরা গুলিস্থান? মাটির ঢেলা বলল, এসব আমি কিছু নই, আমি অতি নিচু মাটি, ফুলের সঙ্গে থেকে আমার সুবাস খাঁটি হয়েছে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে রয়েছে একটি বিশাল কার্পেট। জাতিসংঘের প্রবেশপথের দেয়ালে সেঁটে থাকা সেই কার্পেটটি ইরানি জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া উপহার। যার মাঝখানে লেখা আছে মহাকবি শেখ সাদির একটি কবিতা। বলা হচ্ছে ‘সব মানুষ এক দেহের অঙ্গসম; যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই। যখন একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারে না। অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও, তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।’

শেখ সাদি তার গুলিস্তাঁয় লিখেছেন, আমি কখনো কালের কঠরতা ও আকাশের নির্মমতার ব্যাপারে অভিযোগ করিনি। তবে একবার নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ পায়ে তখন জুতা তো ছিলই না এমনকি জুতা কেনার মতো অর্থও ছিল না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ইরাকের মসজিদ আল কুফায় গিয়ে উঠলাম। তখন দেখি একটি লোক শুয়ে আছে যার একটি পা-ই নেই। তখন খোদাকে শোকর জানিয়ে নিজের খালি পা থাকাও সন্তুষ্ট হলাম। হাঁটতে হাঁটতেই তিনি দেখেছেন মুসলিম সাম্রাজ্যের শৌর্য-বীর্য, সঙ্গে সঙ্গে পতনের দৃশ্য। পায়ে হেঁটে তিনি চৌদ্দবার হজ পালন করেছেন। ভ্রমণের মধ্যে ছিল পারস্য সাগর, ভারত মহাসাগর, ওমান সাগর, আরব মহাসাগর পাড়ি। কথিত আছে, ভারত সাগর ভ্রমণ বাদে সাদি আরও তিনবার ভারতবর্ষে পদার্পণ করেছিলেন।

পাঠানরাজ আলতামাশের সময় তিনি কিছুকাল দিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। চতুর্থবার তিনি বিখ্যাত কবি ও গায়ক আমির খসরুকে দেখতেই ভারতে আসেন। সাদি পুবে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ অবধি এসেছিলেন। এরপরে খ্রিষ্টীয় ১৩ শতাব্দির শেষভাগে মুলতানের শাসক যুবরাজ মুহাম্মদ খান শহিদ তার পিতা গিয়াসুদ্দিন বলবনের পক্ষ থেকে শেখ সাদিকে ভারতে আসতে দুবার আমন্ত্রণ জানান।

শেখ সাদীর শিক্ষণীয় এই গল্পটিও বেশ জনপ্রিয়। তবে এর আবেদন কোনো কালেই কমবে না। একবার শেখ সাদি সম্রাটের কাছে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে রাত হলে এক বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে আশ্রয় পেলেন। বাড়ির পক্ষ থেকে সামান্য কিছু খাবারও জুটল। পরের দিন শেখ সাদি বিদায় নিলেন। শেখ সাদিকে পেয়ে সম্রাট অনেক খুশি। সেজন্য বিদায় বেলায় কবিকে সম্রাট বেশ দামি উপহার ও একটি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক দিলেন। শেখ সাদি সেই পোশাক পরে উপহার নিয়ে বিদায় নিলেন। ফেরার পথে সেই একই বাড়িতে আবার রাত্রিকালীন আশ্রয় নিলেন। বাড়ির লোকেরা এবার তাকে দেখে সম্মানের সঙ্গে নিজেদের সোয়ার ঘরে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।

একই সঙ্গে অনেক ধরনের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। সবার সঙ্গে খেতে বসে শেখ সাদি না খেয়ে সব খাবার পোশাকের পকেটে রাখতে লাগলেন। তা দেখে বাড়ির একজন কৌতূহল ধরে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি না খেয়ে খাবারগুলোকে পোশাকের পকেটে কেন রাখছেন। শেখ সাদি বললেন, আমি যখন কয়দিন আগে এ বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলাম তখন আমার অবস্থা খুব সাধারণ ছিল। তাই আমার সমাদরও ছিল খুব সাধারণ। আজ আবার যখন এ বাড়িতে আসলাম তখন আমার অবস্থা খুব উচ্চ অবস্থায়। এর সবই পোশাকের গুণেই হয়েছে। তাই খাবারগুলো তারই প্রাপ্য। তাই আমি না খেয়ে পোশাককে তা খাওয়াচ্ছি। একথা শুনে তাদের খুব লজ্জা হলো এবং এ রকম ব্যবহারের জন্য তারা শেখ সাদির কাছে ক্ষমা চাইলেন।

শেখ সাদীর যত রচনা সবই উপদেশ, খোদার প্রেম ও রাসুলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের নানা উদাহরণে পূর্ণ। শেখ সাদী চাইতেন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভূলে সবাই যেনো সবাইকে আপন করে নেয়। ভালোবাসা ও প্রেমে ভরপুর এক পৃথিবী তৈরি হয়। আমাদের সময়.কম

পাঠকের মতামত

Comments are closed.