225736

ইমাম হাসান (আ.) এর ইমামতের সময়কালের মর্মস্পর্শী ঘটনা

আমিরুল মুমেনিন আলী (আ.)’র শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.)’র ইমামতের সময়কাল শুরু হয়। এ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)’র পত্র বিনিময় এবং এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সন্ধি চুক্তি করার পুরো সময়টাতে বড় ভাইয়ের পাশে ছিলেন ইমাম হোসেইন (আ.)।

ইমাম হাসান সন্ধি চুক্তি সই করার পর কুফা থেকে মদীনায় চলে যান এবং সেখানে ১০ বছর পর শাহাদাতবরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর ইমাম হোসেইন (আ.)’র ইমামতের যুগ শুরু হয়। আজকের আসরে আমরা এই যুগের সূচনাপর্বের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করব।

ইমাম হাসান (আ.)’র শাহাদাতের পরও মুয়াবিয়া আরো ১০ বছর বেঁচে ছিল। এই ১০ বছর ইমাম হোসেইন (আ.) বড় ভাইয়ের নীতি অনুসরণ করে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মনে করেন, বেশিরভাগ মানুষ যখন মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কূটকৌশলের ফাঁদে পা দিয়েছে তখন মুসলিম উম্মাহর জন্য শান্তির পথ অবলম্বনই শ্রেয়। যদি সিফফিনের যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধ বাধে তাহলে কোনো পক্ষের কোনো অর্জন ছাড়াই হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরবে এবং এর ফলে ইসলামের শত্রুরা লাভবান হবে। ইমাম আলাইহিমুস সালামগণ মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কখনো যুদ্ধ করেছেন আবার কখনো শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন। কখনো নিশ্চুপ থেকেছেন আবার কখনো সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন। অন্য কথায় সব ইমামের মৌলিক নীতি অভিন্ন হলেও তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল পরিবর্তন করতেন। এই কৌশল অবলম্বন করেই মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় বড় ভাই ইমাম হাসানের মতো শান্তির পথে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেন ইমাম হোসেইন (আ.)। অবশ্য তিনি মুয়াবিয়ার শাসনের কুসংস্কার ও অত্যাচারের ব্যাপারে নীরব থাকেননি। কিন্তু মুয়াবিয়া বাহ্যিক বেশভুষায় মুসলমানিত্বের দাবি করে জনগণকে এমনভাবে ধোঁকা দিয়ে রেখেছিল যে, তাদের পক্ষে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সব সময় বাহ্যিক পোশাক-আশাক দেখে একজন মানুষের ঈমানদারিত্ব পরিমাপ করে। ইমাম হোসেইন (আ.)’র যুগের মুসলমানরা ঠিক এ কারণেই যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসেইনকে উপেক্ষা করে মুয়াবিয়ার দলে যোগ দেয়। তবে বুৎপত্তিসম্পন্ন ঈমানদার মুসলমানরা এক মুহূর্তের জন্যও সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ পরিহার করেননি। তারা বরং বনি উমাইয়ার শাসকদের কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শহীদ হওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন। এই ঈমানদার ব্যক্তিদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন হুজ্‌র ইবনে আদি কেন্দি। তার নেতৃত্বে একদল ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমান মুয়াবিয়ার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে বনি উমাইয়ার শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইমাম হোসেইন (আ.) এই মর্মান্তিক ঘটনার ব্যাপারে চুপ থাকতে পারেননি। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ সময় গুপ্তচররা ইমামের বিরুদ্ধে মুয়াবিয়ার কাছে নালিশ জানালে মুয়াবিয়া ইমামের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। ইমাম ওই চিঠির উত্তরে লেখেন:

আমার হাতে তোমার এমন একটি চিঠি এসে পৌঁছেছে যাতে তুমি জানিয়েছো যে, আমার সম্পর্কে অসন্তোষজনক খবর তুমি শুনেছো। সেইসঙ্গে তুমি জানিয়েছো যে, আমার কাছ থেকে এমন আচরণ তুমি আশা করোনি।… জেনে রেখো, যারা তোমার কাছে এ খবর পাঠিয়েছে তারা মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্যের বীজ বপন করছে। আমি যেমন তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোনো চিন্তা করিনি তেমনি যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতিও নেইনি। কিন্তু তাই বলে তুমি কখনো একথা মনে করো না যে, তোমার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নীরব থাকা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক। বরং এই নীরবতা আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন কিনা আমি সেই আশঙ্কায় রয়েছি। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) হুজ্‌র ইবনে আদি’র শাহাদাতের প্রসঙ্গ টেনে মুয়াবিয়াকে আরো লেখেন: তুমি কি হুজ্‌র ইবনে আদি’কে হত্যা করোনি? তুমি কি তার ঈমানদার ও নামাজি সহযোগীদের গর্দান নাওনি? তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কেন তাদেরকে আটক করে বন্দি অবস্থায় হত্যা করলে?

ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠির অন্যত্র বলেন: তোমার চিঠিতে আমাকে হুমকি দিয়ে লিখেছ, তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিবর্তে আমি যেন নিজের জীবন, দ্বীন ও উম্মতকে রক্ষা করার লক্ষ্যে নীরবতা অবলম্বন করি। কিন্তু তুমি জেনে রেখো, আমি যদি তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেই তাহলে আল্লাহর কাছে তা হবে অনেক বেশি পছন্দনীয়। কিন্তু যদি তোমার বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকি তাহলে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং সেক্ষেত্রে আমাকে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চিঠির শেষাংশে ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়াকে লেখেন: তুমি নিজেকে ঐশী প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত করো এবং জেনে রেখো আল্লাহ তায়ালা তার আদালতে তোমার বিচার করবেন। সেই আদালতে তোমার মানবতা বিরোধী ও ধর্ম বিরোধী কর্মকাণ্ডগুলো উত্থাপন করা হবে।

বন্ধুরা! আমরা শুরুতেই যেমনটি বলেছি, মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় তার শাসনের ব্যাপারে ইমাম হোসেইন (আ.) তাঁর অগ্রজ ইমাম হাসান (আ.)’র নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইমাম হাসান যেমন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন তেমনি ইমাম হোসেইনও ইসলাম রক্ষা, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা ও নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকেন। মুয়াবিয়া নিজেকে ইসলামের ধ্বজাধারী বলে প্রচারণার এমন ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছিল যেখানে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেই সহজ-সরল মুসলমানরা তাকে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ মনে করত। সাধারণ জনগণের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার ওপর ভর করে মুয়াবিয়া নিজেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল যে, সে তার ভাষায় ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ইমাম হোসেইকে অভিযুক্ত করতেও দ্বিধা করেনি। মুয়াবিয়া ইমামকে ফেতনা পরিহার করার আহ্বান জানানোর ধৃষ্টতা দেখায়। এ কারণে ইমাম হোসেইন (আ.) এক চিঠিতে মুয়াবিয়াকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে দিয়ে বলেন: তুমি আমাকে ফেতনা সৃষ্টি না করার আহ্বান জানানোর মতো ধৃষ্টতা দেখাও? কিন্তু আমি তো মুসলিম উম্মাহর জন্য তোমার শাসনের চেয়ে‌ আর কোনো কিছুকে বড় ফেতনা বলে মনে করি না। পার্স টুডে

পাঠকের মতামত

Comments are closed.