215364

চুনী বাবুর গল্প

কিযী তাহনিন : চুনী বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের কিংবা অল্পদিনের, আমার তা এখন আর মনে নেই। হিসাব করলে দেখা যাবে সেই পরিচয় সতেরো বছরের কিংবা সাত বছরের। সেই হিসাব এখন আর কারো মনে নেই। কিছু মানুষ নিজগুণে আকর্ষণীয়। চুনী বাবুর মূল আকর্ষণ তার মুখভরা পান, যে পানের চিবুনি তার মধ্যে একটি ‘কোনো কারণ ছাড়া সুখী’ ইমেজর জন্ম দিয়েছে। চুনী বাবুর আসল নাম এলাকার কেউ জানে না। শুধু জানে, প্রতি রোববার এক বালতি চুন নিয়ে সে এলাকায় আসে। বাড়ি বাড়ি চুন বেচে। পুরো সময় তার মুখভরা পান, চোখভরা হাসি। নাম না জানা চুনী বাবু রোববার এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বাড়ির উঠানে এসেও দাঁড়ায়।

প্রতিবার নির্ভুলভাবে একইরকম চিকন সুরে ডাক দেয়, ‘বাবু সোনা, মা জননী কে আছো গো, চুন নাও।’ আমার দাদি ডাক শোনামাত্র কিংবা ডাক শোনার কয়েক মুহূর্ত আগেই চুনের খালি কৌটা নিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ায়। মেপে মেপে চুন নেয়, সারা সপ্তাহের জন্য। আজ দাদির জ্বর। সঙ্গে বাতের ব্যথাটাও বেড়েছে। চুনী বাবুর ডাক শুনে তাই আমিই কৌটা হাতে বেরোলাম। চুন নিতে নিতে বলি, ‘দাম একটু কম রাখেন চুনী বাবু, আমরা এতো পুরনো কাস্টমার।’ ‘যে দামে কিনি, ঠিক সেই দামেই বিক্রি করি মা জননী।’ পান চিবানো, আর কাঁচা সুপারির গন্ধ মাখানো হাসিতে চুনী বাবু উত্তর দেয়।

‘মানে কী, যে দামে কেনেন সে দামে বেচেন। কেন? এতে লাভ কী?’ আমি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করি। ‘এই যে আপনারা সম্মান করে চুনী বাবু বলে ডাকেন, সেই বাবু ডাক শোনার লোভে কিংবা লাভে…’ চুনী বাবু উত্তর দেয়। চুনী বাবু প্রতিবারের মতো হেলেদুলে পেছনে না তাকিয়ে চলে যায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে চুনী বাবুর চলে যাওয়া দেখি। ভাবী, আমরা সবাই তো আসলে একেকজন চুনী বাবু। কতো কিছু হারিয়ে ফেলি, কতো পথ হেঁটে যাই, কখনো কিছু পাবো বলে। ‘বাবু’ ডাক শোনবার কিংবা এক কড়ি সমান আনন্দ খোঁজার বায়বীয় এক আকর্ষণে, হারিয়ে ফেলা সুতা ছেঁড়া এক কাটাঘুড়ির সন্ধানে চুনী বাবুর মতো আমরা সবাই ছুটছি, ছুটছি… চুনী বাবুর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার নিজেকেও একজন চুনী বাবু বলে মনে হচ্ছিলো …।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.