214525

গল্পটি একজন মুক্তিযোদ্ধার

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন মো. তবিবুর রহমান (রুনু) ছিলেন একজন নির্ভীক ও আদর্শবান মানুষ। দেশপ্রেমের টানে একাত্তরে যেমন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তেমনি স্বাধীনতার পরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে দেশের ও মানুষের সেবা করে গেছেন। আব্দুস সামাদ মোল্লা এবং মেহেরুন নেসার প্রথম সন্তান মো. তবিবুর রহমান (রুনু) জন্মগ্রহণ করেন নড়াইল জেলার, লোহাগড়া থানার যোগিয়া গ্রামে। ব্যক্তিগত জীবনে তার আচার-ব্যবহার ছিলো অত্যন্ত চমৎকার। তিনি ছিলেন একজন ধৈর্যশীল মানুষ যিনি তার জীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছেন পরোপকার ও সমাজসেবায়।

শিক্ষা জীবনের শুরুতে তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘ইতনা’তে অবস্থিত ‘ইতনা ইংলিশ হাই স্কুল’ থেকে মেট্রিকুলেশান পাস করেন। স্কুলের পাঠ শেষে তিনি খুলনা বি.এল. কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন এবং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। একই কলেজে ডিগ্রি ৩য় বর্ষে থাকাকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মনোনয়নে উক্ত কলেজের জি.এস. হিসেবে নির্বাচিত হন। সফলভাবে ডিগ্রি পরীক্ষায় পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। তার সহপাঠীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কালামউদ্দিন আহম্মেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, সাবেক কেবিনেট সচিব সাদাত হোসাইন অন্যতম ছিলেন।

এ সময় তিনি ঢাকাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তার এক বোনের বাড়ি ঢাকার শুক্রাবাদে অবস্থিত হবার ফলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তিনি নিয়মিত যাতায়াতের সুযোগ পেতেন। সেই সুবাদে তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তার পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহবশত ‘লাল’ বলে ডাকতেন। শেখ শহীদ, রাশেদ মোশাররফ এবং তিনি দীর্ঘ সময় ৩২ নম্বরে অবস্থান করতেন বলে অন্যরা তাকে ৩২ নম্বরের পাহারাদার বলে সম্বোধন করতো।

৭০-এর শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু পূরবাণী হোটেলের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে তার যোগদানের ব্যবস্থা করেন। রাজনীতিতে অধিকতর সম্পৃক্ত হবার কারণে তিনি তিন মাস পরে পূরবাণী হোটেলের চাকরি ত্যাগ করেন এবং সর্বক্ষণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই থাকতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে গৃহত্যাগের অনুরোধ জানান। অনেক লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী রুনু বঙ্গবন্ধুর পা জড়িয়ে ধরে গৃহত্যাগের জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘লাল, তুই নিজে এখনি পালিয়ে যা, ওরা যদি আমাকে না পায় তাহলে পুরো ঢাকা শহর ছারখার করে ফেলবে। ‘অতঃপর, তিনি বঙ্গবন্ধুর উপদেশমতো বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।

চারদিকে তখন পাক হানাদার বাহিনীর তা-ব চলছে। এরই মাঝে তিনি ধানম-ির ৩২ নম্বরের সাবেক সংসদ সদস্য বেগম বদরুন্নেসার বাড়ির বাউন্ডারি দেয়ালের পাসের ড্রেনের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থেকে সারারাত কাটিয়ে দেন। এরপর তিনি ঢাকা ত্যাগ করে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং সেখান থেকে তিনি এলাকার সক্রিয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে যুক্ত হয় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে থানা ও জেলা পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেসময় যশোর জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত তার সহপাঠী ‘সাদাত হোসাইনে’র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবিবুর রহমান রুনুর অনুরোধে সাদাত হোসাইন তার নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে রুনুর সঙ্গে নড়াইলের যোগিয়াতে চলে আসেন। যোগিয়াতে অবস্থানকালে দু’জনই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। প্রায় দেড় মাস পরে সাদাত হোসাইন মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে যোগিয়া ত্যাগ করেন। এ সময়ে তবিবুর রহমান (রুনু) খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্দেশ্যে একে একে ভারতে পাড়ি দিচ্ছেন এবং তিনি নিজেও ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

৭১-এর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে খুলনার তৎকালীন এম.এন.এ. ডাক্তার মুনসুর আলী তেরোজন নেতাকর্মীসহ ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে তবিবুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে ওঠেন। সেই রাতেই রুনু ও অন্য সকলে ইতনার অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে থাকা শরণার্থীদের দলভুক্ত হয়ে ভারতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেসময় তার দুই ভাই জিল্লুর রহমান ও খায়রুজ্জামান হীরা তার সঙ্গে রওয়ানা করেন। কখনো নৌকাযোগে, কখনো পায়ে হেঁটে প্রায় তিনদিন পরে তারা সকলে ভারতের বোনগাঁ মহকুমার বাগদা বর্ডার হয়ে ভারতে পৌঁছান। পৌঁছানোর পর পরই ডাক্তার মুনসুর আলী ও তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কলকাতায় রওয়ানা হন এবং তার দুই ভাইসহ অন্যরা সকলে বোনগাঁর টালিখোলাতে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগদান করেন। সেসময় মুজিবনগর সরকার তাকে একজন ইমপ্লয়ি হিসেবে নিয়োগ দেন এবং সরকার তাকে বোনগাঁর টালিখোলার মুক্তিযুদ্ধ ইয়ুথ ক্যাম্পে ‘ডেপুটি ক্যাম্প ইনচার্জ’ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল সক্রিয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর মুজিবনগর সরকারের ইমপ্লয়িরা সকলে একে একে দেশে ফেরত আসতে শুরু করেন এবং তিনিও দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর ৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশে স্বাধীন সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় মো. তবিবুর রহমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস’ (বিসিএস) পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন এবং নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক্রমে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগদান না করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনÑএই থেকে যান। তিনি বঙ্গবন্ধুর এতোটাই স্নেহাসিক্ত ছিলেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে তাকে হাতের ইশারায় গাড়িতে তুলে নিতেন’ বিভিন্ন সময়ে এমনও দেখা গেছে।

তাসমিয়া নুহিয়া আহমেদ, ডেইলি আওয়ার টাইমের নির্বাহী সম্পাদক

পাঠকের মতামত

Comments are closed.