209532

‘সম্পদ খায় লোকে, দেহ খায় পোকে’!

অসীম সাহা : বহুদিন আমি বারিধারা অঞ্চলে যাই না। শেষ কবে গিয়েছিলাম, তাও মনে নেই। আর শিল্পপতি, যমুনা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী নূরুল ইসলাম বাবুলের ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’-এর নাম শুনেছি, কিন্তু সেটি নির্মিত হবার পর কোনোদিন সেখানে যাওয়া হয়নি। ভারতীয় দূতাবাসের ভিসা সেন্টারও ফিউচার পার্কে। তাই আগরতলার ভিসার জন্যে কদিন আগে সেখানে যেতে হয়েছিলো। বিশাল পার্ক। সম্পূর্ণ এরিয়ায় চমক লাগানো ব্যাপার-স্যাপার। দেখে চোখে তাক লেগে গেলো। ঢাকা সবদিক থেকে এতোদূর এগিয়েছে, ভাবতেও পারিনি।

কয়েকদিন আগে কবি নির্মলেন্দু গুণ আমার চোখ খুলে দিলো। হাতীরপুলে আমাদের কবি-জংশনের আড্ডায় তিনি জানালেন, “কলকাতার চেয়ে ঢাকা আয়তনে আনেক বড়।” আমি প্রতিবাদ করলাম। তিনি মোবাইলের গুগলে সার্চ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার ভুল ভেঙে দিলেন। আমি জানলাম, ঢাকার আয়তন ৩০৬ কিলোমিটার আর কলকাতার ২০০ কিলোমিটার। নির্মলেন্দু গুণ আর একটি চমক লাগানো কথা বলে আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে দিলেন, “আপনি বলুন তো, কলকাতায় ‘বসুন্ধরা’ মার্কেটের মতো এতো বড় একটি শপিং মলের কথা?” আমি মন ঘুরিয়ে কলকাতাকে তন্ন তন্ন করে দেখে অনেক চেষ্টা করেও এমন একটি মার্কেট খুঁজে পেলাম না!

তিনি যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়েছিলেন কিনা জানি না। কিংবা গিয়ে থাকলেও তার মনে ছিলো না বোধহয়! তা না হলে তিনি ঐ পার্কের কথা বলে আমাকে একবারে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতেন! যতো বড় পার্ক, ততো বড় আয়োজন। আর আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে ভারতীয় ভিসা সেন্টারের আকার দেখে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। সত্যি ঢাকা আর ঢাকা নেই, দিগন্তস্পর্শী আকাশের সীমার দিকে সে ক্রমশ ধেয়ে যাচ্ছে!

কিন্তু আমার আজকের লেখার মূল বিষয় সেটি নয়। আমি বলতে চাইছি এই যে, বিশাল বিশাল শপিং মল, এতো বড় বড় পার্ক এসব ছাপিয়ে যা আমাকে সবচেয়ে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করেছে, তা হলো বারিধারা থেকে ফেরার পথে সামনে ধেয়ে চলা একটি ছোট নীল রঙের ট্রাকের পেছনে লেখা, “মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে তার বিবেক।” তার নীচে লেখা দুটি লাইন আমার চোখ দুটিকে আরো স্থবির করে দিলো “সম্পদ খায় লোকে, দেহ খায় পোকে।” যিনি এই কথা দুটি ট্রাকের পেছনে লিখেছেন, তিনি কে আমি জানি না।

তবে তিনি বসুন্ধরা কিংবা যমুনার মালিকের মতো বিশাল শিল্পপতি নন। একজন সামান্য মানুষ বা সাধারণ পথশিল্পী। যে কথাটি তিনি বুঝেছেন, সে-কথাটি কি বসুন্ধরা, যমুনা বা অন্য শিল্পের মালিকরা বোঝেন? যদি বুঝতেন, তা হলে তো তারা “রাজার হস্ত করে সমস্ত, কাঙালের ধন চুরি” রবীন্দ্রনাথের এই কঠিন বাক্যটি মনে রাখতেন! কিন্তু সে বিবেক কই? এদেশে কি বিবেকের কথা মনে রেখে মানুষরা কাজ করেন?

মানুষ মরণশীল এবং এ-জীবন ক্ষণস্থায়ী। ধন-সম্পদের প্রতি মোহ মানুষকে ক্রমশ বিবেকবানের বদলে বিবেকহীন করে তুলছে। তাই এদেশে বিত্তশক্তি ও পেশিশক্তির যতো দাপট, চিত্তশক্তির সে-দাপট নেই। যারা অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের জন্য সব রকমের বিবেকহীন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে উন্মত্ত উল্লাসে ক্রমশ উন্মাদ হয়ে উঠছেন, তাদের ভাবখানা এমন যে, তারা অমর, তাদের মৃত্যু নেই, তারা তাদের সকল ধনসম্পত্তি মৃত্যুর সময় নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন। যে জীবনের এক মুহূর্তের ভরসা নেই, সেই জীবনকে কলুষিত করার জন্য হেন কাজ নেই, যা তারা করতে পারেন না!

তারা একবারও ভেবে দেখেন না, মৃত্যুর পর মাটির নীচে দেহটি যখন কবরে শায়িত হবে, তখন তাদের দেহ পোকা-মাকড়ে খেয়ে ফেলবে! যে কথাটি সাধারণ মানুষ বোঝে এবং অপরাধ করে কম, সেখানে কথাটি নিয়ে অবৈধ ধন-সম্পদের মালিকরা একবারও ভাবেন না? ভাবলে তারা অপরাধের মাত্রাটা অন্তত কমিয়ে দিতেন। পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতে পারতো। বিশেষত আমাদের প্রিয় স্বদেশ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ট্রাকের পেছনে এই বিবেকহীনদের বিবেক জাগ্রত করার জন্য এমন কথা লিখতে হতো না। আমরা কবে আমাদের দেশকে এমন একটি দেশে পরিণত করতে পারবো? আমাদের সময় ডটকম
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়

পাঠকের মতামত

Comments are closed.