209226

রাবা খানের ‘বানDhobi’ বই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নিন্দার ঝড়

আমাদের দেশে যারা কৌতুক করতে ভালোবাসে, তাদেরকে আমরা দেখি হালকা গোছের মানুষ হিসেবে। তাদের কথার গুরুত্ব কম। আপনি চাইলে সিনেমার দিকে তাকাতে পারেন। প্রয়াত দিলদারের দিকে তাকান।

সহস্র খানেক সিনেমায় অভিনয় করে, কোটি মানুষকে হাসিয়েছেন, কিন্তু আমরা কাউকে ছোট করতে, “মজা করতে” তাকে দিলদার ডাকি, টেলি সামাদ ডাকি। আপনি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকান। জিম ক্যারি, বেন স্টিলার কিংবা ব্যারন কোহেন (আলাদীন মাদাফা*, বোরাট) এর দিকে দেখেন। মানুষ মাথায় করে রাখে এদেরকে, আমি আপনিও রাখি।

ইউএসএ, ইউকে বাদ দেন, ভারতের দিকেও যদি দেখেন, ওদের দেশে বিভিন্ন ক্লাব, পাব এ স্ট্যান্ড আপ কমেডি শো হয়। হুমড়ি খেয়ে মানুষ দেখতে যায় সেগুলা। ইউট্যুবে দেখা হয় আমার, হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায়। এরা কেউই প্রোফেশনাল না বলতে গেলে। চাকরি করে, নিজের স্টার্ট আপ আছে কিংবা এখনও ছাত্র ছাত্রী। ব্যাপারটা তাদের পেশায় ইফেক্ট ফেলে না। আফটার অল, প্রেমের গল্প লিখে বা বলে মানুষকে কাঁদানো যতোটা সহজ, তার থেকে অনেক কঠিন মানুষকে হাসানো। আর এই কাজটা যারা সহজে করতে পারে, আমরা তাদেরকে গুরুত্বহীন ভাবি, মনে মনে বলি, ‘কার্টুন একটা, চিড়িয়া একটা, জোকার একটা।’

স্ব-স্বীকৃত ১৯ বছর বয়েসী রাবা খান নাম্নী একটি মেয়ে বাংলা অনলাইনে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন মূলত তার সেন্স অফ হিউমর এর কারণে। বিভিন্ন সিচুয়েশনে বিভিন্ন ক্যারেক্টার কিরকম বিহেইভ করে এসব অভিনয় অবলীলায় করতেন, মানুষ খুব সহজে ব্যাপারটা গ্রহন করলো। এরপর ধাপে ধাপে মেয়েটি নিজের প্রোডাকশন হাউজ ‘ঝাকানাকা’ তে বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করলো। বিভিন্ন ভিডিওতে কৌশলে বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপন যেভাবে দেয়। এটা বিজ্ঞাপনের খুবই স্মার্ট একটা পন্থা। হলিউডের মুভিতে পর্যন্ত অডি গাড়ি, বিভিন্ন মোবাইল ফোনের এরকম বিজ্ঞাপন দেখা যায়। ধীরে ধীরে বিনোদন জগতে খ্যাতি অর্জন করতে থাকে মেয়েটি। সমস্যাটা শুরু হয় সেখান থেকে। সমস্যাটা উভমুখী। রাবা খান ও তার ফ্যান-ফলোয়ার্স, দুই দিক থেকেই।

প্রথমত রাবা খান এর মধ্যে একটা ওভার কনফিডেন্স তৈরি হতে থাকে। কারণ এখন পর্যন্ত যেখানেই হাত দিচ্ছেন সেখনেই সোনা ফলছে (অর্থাৎ, আপাত সফলতা লাভ হচ্ছে)। যদিও তিনি দাবী করেন তিনি ১৯বছর বয়েসী, তিনি যদি আরও ২/৩বছর বয়স বেশীও হয়ে থাকে, এই অল্প বয়সে এতো দ্রুত সফলতা অর্জনে যে কারোরই মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। আরেকটু অল্প বয়সে দেখবেন, ১৬-১৭বছর বয়েসী ছেলেরা ডিএস এল আর একটা কিনেই ফটোগ্রাফি পেইজ খুলে ফেলে, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি শুরু করে দেয়। দেখবেন, নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেই এংগেজমেন্ট, খত্না, জন্মদিনের অর্ডার নেয়া শুরু করে দিয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্লান্ডার হয়।

দ্বিতীয়ত, ফ্যান ফলোয়ার্স এর কথা বলি। আমরা খুবই হিংসুক। জাতিগত ভাবে নাকি মানুষ মাত্রই হিংসুটে, সেটা গবেষণার ব্যাপার। কম বয়স্ক একটা মেয়ে যখন তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে, এটা অনেকেরই ভালো লাগে না। একটা মেয়ে বাসায় বসে ভিডিও বানায়, লোক হাসায়, কমেডি হিসাবে মজা লাগে। কিন্তু ঐ যে, কমেডিয়ানরা গুরুত্বহীন, এরকম একটা মেয়ে কমেডি করে গ্ল্যামার পাচ্ছে, টাকা কামাচ্ছে, এটা অনেকেরই পছন্দ হবার কথা না।

ওভার কনফিডেন্স এর কারণে হোক আর কম বয়সের কারণে হোক, রাবা খান একটি অখাদ্য পুস্তক লিখেছেন ও বাধাই করে বইমেলায় সরবরাহ করেছেন। বইটির কন্টেন্ট এতো নিম্ন মানের যে টাকা দিয়ে আমি কখনওই সেই বইটি কিনবো না। বাংলা ইংরেজির মিশেল, ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা, কখনও কখনও হিন্দীর প্রবেশ – সব মিলিয়ে ইংরেজিতে ডিজেস্টার বলা যায় বইটিকে। এর দায় রাবা খানের যতটুকু, তার থেকে কোনভাবেই প্রকাশকের কম নয়। যে প্রকাশনীটি বইটি ছাপিয়েছে, তারা বাজারি, রাবা খান এর চেহারা (আক্ষরিক অর্থে চেহারা নয়) বিক্রী করে বই বিক্রী তাদের উদ্দেশ্য এতে নিশ্চয়ই কারও সন্দেহ নেই। এদের কর্মকাণ্ড দেখে আমি নিশ্চিত, আগামী বইমেলায় লাখ ফলোয়ার্স সমৃদ্ধ, গ্ল্যামারাস কেউ যদি ‘আমার কোষ্ঠকাঠিন্য কালের বেদনা’ নামে ইংরেজি অক্ষরে আরেকটি বই ছাপাতে চায়, তারা সেটাও ছাপাবে। কাগজ বিক্রী করাটা তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, বই না।

রাবা খানের লিখিত বইটি শুধু যে ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখায় দুষ্ট, তাই না, ভয়ানক ইংরেজি ব্যাকরণগত ভুল সমৃদ্ধও। ‘১৯’ বছর বয়সে আমি যদি বাংলাতেও বই লিখতাম, তবে বাংলাতেও গুরুচণ্ডালী ভুলে মাখামাখি বই হতো আমি নিশ্চিত। ফেসবুকে আমার বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই-বোন আমার অনুগল্প পড়ে আমাকে উতসাহ দেন বই লিখবার। আমি লিখি না, কারণ ফেসবুকের মতো একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিনামূল্যে যে কারও লেখা পড়া যায়, ভালো লাগলে ‘লাইক’, ভালো না লাগলে স্ক্রল করে চলে যাওয়া যায়, তার সাথে বই এর তুলনা হয় না। টাকা খরচ করে যারা ‘নিশম ভাই’ এর বই কিনবেন, লেখা মান সম্পন্ন না হলে তারাই ‘চুদির্ভাই’ বলে গালি দিবে। আর তাই, নিজেকে যতোদিন যোগ্য বলে মনে না হবে, ততোদিন ছাপার অক্ষরে বই বের করবার কোন মানে হয় না।

রাবা খান এর বইটি সাহিত্যমানে জিরো ইম্প্যাক্ট এর একটি বই হতে পারে, তবে এতোটুকু নিশ্চিত এই বইটি কাউকে আঘাত করে না, আঘাত করতে কাউকে উদ্বুদ্ধ করে না। ধর্ষণ নিয়ে এনালজি দাড় করায় না। সর্বোপরি, কাউকে হত্যা করতে আগ্রহ জন্মায় না। অপরদিকে, ফেসবুকে একসময়কার বিশাল ইসলামিক লেখক বলে পরিচিত ফারাবী ফতোয়া দিতো বিভিন্নজনকে হত্যা করতে হবে। একালের বুদ্ধিদীপ্ত নতুন ফারাবী, আরিফ আজাদ প্যারাডক্সিকেল সাজিদ বিজ্ঞান বনাম ধর্মতে, বিজ্ঞানকে এক হাত দেখে নেবার জন্য ধর্ষন এর মতো অপরাধকে এনালজি হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ, এর প্রতিফলনে আমরা দেখতে পাই, লিবারেলিস্ট-প্রগতিশীল-ফান্ডামেন্টালিস্ট-ইসলামিস্ট নির্বিশেষে সকলে রাবা খানকে ধুয়ে দিচ্ছে। অবাক হয়েছি যখন প্রগতিশীল বলে পরিচিত বিভিন্ন নারীও, রাবা খান এর নাম বিকৃত করে ‘শিশ্ন’ সমার্থক একটি শব্দ দিয়ে তাকে অভিহিত করছে। অপরদিকে প্যারাডক্সিকেল সাজিদ মেলার বেস্ট সেলার। ইসলামিস্ট-ফান্ডামেন্টালিস্টদের কাছে সে নতুন জাকির নায়েক। ফ্যালাসিতে ভরপুর সাজিদ নিয়ে এর এক দশমাংশ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।

নেগেটিভ মার্কেটিং এর মাধ্যমে মেকাপ সর্বস্ব, বেবিডল নুসরাত ফারিয়া আজকে নায়িকা, হিরো আলম বহি:বিশ্বে বাংলাদেশ এর প্রতিনিধিত্বকারী অভিনেতা, রাবা খান উইমেন ইম্পাওয়ারমেন্ট এর প্রতিভূ। এর দায় আমাদের। তারামন বিবি, সেতারা বেগমদের গ্ল্যামার নেই। তাই তারা উইমেন ইম্পাওয়ারম্যান্ট এর ধারক-বাহক মানতে আমাদের কষ্ট হয়, স্মার্ট-পশ জেনারেশন এর জন্য হাইফাই হোটেলের বলরুমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাই জায়গা হয় না তাদের। আমাদের জন্য রাবা খানেরা যোগ্য না, তো কে যোগ্য?
লেখকঃ ডাঃ নিশম সরকার
উপদেষ্টা,সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ
এমবিবিএস ,ঢাকা মেডিকেল কলেজ (লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)

পাঠকের মতামত

Comments are closed.