208660

ইয়াবার মরণ নেশার পরিণতি ও মা-বাবার সুন্দরী প্রিন্সেসের নীরব আর্তনাদ!

ডেস্ক রিপোর্ট : মা-বাবার আদরের মেয়ে। সুদর্শনা। বাবা ডাকতেন প্রিন্সেস। ব্যবসায়ী বাবা ভীষণ ব্যস্ত। ফিরতেন রাতে। বাসায় ফিরে বাবা যাকে প্রথমেই খুঁজতেন তিনি বর্ষা। মা গৃহিণী। ব্যস্ত থাকেন ঘর নিয়েই।

মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে বর্ষা। বর্ষা লেখাপড়া করতেন ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেই সুন্দরী প্রিন্সেসের এখন বেহাল দশা। মুখ শুকিয়ে গেছে। চেহারার দিকে তাকানো যায় না। তাকে ভর্তি করা হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। বর্ষাসহ অন্তত ২৭ তরুণী রয়েছেন এখানে। তারা সবাই বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

গতকাল কথা হয় বর্ষার সঙ্গে। তিনি জানান, কখনও ভাবেননি মাদক সেবন করবেন। শুরুটা হয়েছিল প্রায় দু’বছর আগে। বন্ধুদের সঙ্গে বনানীর একটি হোটেলে পার্টিতে গিয়েছিলেন। এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়। নানা আনুষ্ঠানিকতার একপর্যায়ে আলাদা একটি রুমে তাকে ডেকে নিয়ে যায় এক বন্ধু। সেখানে ছিল তিন-চারজন। সবাই বিদেশি মদ ও বিয়ার পান করছিল। এরমধ্যে একজন ছিল ব্যতিক্রম। সে সেবন করছিলো গাঁজা। কৌতূহল নিয়ে তার পাশে বসেন বর্ষা। বন্ধুটি গাঁজা ভরা কলকিটি তার দিকে এগিয়ে দেয়। তিনি টান দেন। কাশি আসে। আবার টান দেন। চোখ লাল হয়ে যায়। এভাবে আরও কয়েকবার। তারপর মাথা ঘুরতে থাকে। সে রাতে বাসায় ফিরে আর কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। নীরবে বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকেন। ঘুম আসে খুব। এক ঘুমে সকাল।

এর মধ্যেই নিজের প্রেমিক সম্পর্কে জানতে পারেন, যাকে তিনি অবিবাহিত হিসেবে জানতেন তার স্ত্রী রয়েছে। সে বিবাহিত। খবরটি জানার পর থেকে বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সারা দিন বাসায় থাকেন। ফোন সাইলেন্ট করে রাখেন। খুব কম কলই রিসিভ করেন। লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যান। কিন্তু বাসায়ও ভালো লাগছিল না কিছুতেই। বুকের মধ্যে জমানো কষ্ট কাউকে বলতে পারছিলেন না। এরমধ্যেই ওই বন্ধুকে কল দেন। যার সঙ্গে পার্টিতে গাঁজা সেবন করেছিলেন বর্ষা। তাকে গাঁজা নিয়ে আসতে বলেন। ছেলেটি বর্ষার বাসায় গেলে দুজনে রুমে বসে গাঁজা সেবন করেন। গাঁজায় গন্ধ ছড়ায় তাই রুমে স্প্রে, পারফিউম দেন। এভাবে প্রায় কয়েক সপ্তাহ।

বর্ষা বলেন, গন্ধের কারণে গাঁজা ছেড়ে দেন। ওই বন্ধুর মাধ্যমে ভাষানটেক থেকে আনেন ইয়াবা। ইয়াবা কিভাবে সেবন করতে হয় তা জানতেন না বর্ষা। ইউটিউবে সার্চ দিয়ে একটা ভিডিও দেখে শেখে নেন ইয়াবা সেবন। তারপর নিজে নিজেই ইয়াবা সেবন করেন। শুরুতে বেশ ভালোই লাগতো। এই মরণনেশা সেবনের মধ্য দিয়ে এক ভিন্ন জগতে চলে যেতেন তিনি। নেশায় পেয়ে বসে তাকে। ইয়াবা ছাড়া একদিনও চলে না। বন্ধুটি না এলে নিজেই চলে যেতেন ভাষানটেক। ইয়াবা কিনতেন। মাঝে মধ্যে হোম সার্ভিসও পেতেন। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকা থেকে হোম ডেলিভারি দিতো কয়েক ইয়াবা বিক্রেতা। বিষয়টি ধীরে ধীরে মা-বাবা জেনে যান। মারধর করেন। বাসা থেকে বের হয়ে যান। বন্ধুর সঙ্গে থাকেন সারা রাত। পরদিন বাসায় এলে তাকে ভর্তি করা হয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। এখন সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন এই তরুণী।

একইভাবে মাদকাসক্ত হয়েছেন আরেক তরুণী ঐশী। তার আসক্ত হওয়ার ঘটনাটি একটু ভিন্ন। মঞ্চে অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে টেলিভশিনের কয়েক নাটকে কাজ করেন তিনি। ওজন বাড়ছিল। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তখনই এক সহকর্মী পরামর্শ দেন, ইয়াবা সেবন করলে ওজন কমে। তার কথানুসারেই ইয়াবা সেবন শুরু করেন। ওজন কমছিল ঠিকই। কিন্তু নেশায় আক্রান্ত হন। কোনোভাবেই ইয়াবা ছাড়তে পারছিলেন না। দিনে দিনে এতটাই আক্রান্ত হন যে, ইয়াবা সেবন করে সব ভুলে থাকতেন। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারতেন না। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। এভাবেই নিজের সৌন্দর্য ও শরীর সব নষ্ট হয়ে যায় ঐশীর। এই তরুণীকেও ভর্তি করা হয়েছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে।

নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক তরুণী রুবিনা। তার বিয়ে হয়েছিল গাজীপুরে। স্বামী ব্যবসা করতো। ছোটখাটো একটি মুদি দোকান ছিল। এই দোকানের আড়ালে ইয়াবা বিক্রি করত। পুলিশের ঝামেলা এড়াতে ইয়াবা রাখতো বাসায়। অল্প করে রাখতো দোকানে। কৌতূহল নিয়েই স্বামীর সঙ্গে ইয়াবা সেবন করতেন রুবিনা। রাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে তা করতেন। এভাবে আক্রান্ত হতে থাকেন। তারপর রুবিনা নিজেই ইয়াবা বিক্রি শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে সাপ্লাই দিতেন তিনি। ইয়াবাসহ স্বামী-স্ত্রী গ্রেপ্তারও হন র‌্যাবের হাতে। জামিনে বের হয়ে আবার একই ব্যবসা করেন। স্বামী তার কাছে নিয়মিত টাকা চাইতেন।

টাকা দিতে না পারলে মারধর করতেন। বাধ্য হয়েই স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে নিজেই ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ইয়াবা সেবনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। রুবিনার দুই ভাই ও প্রতিবেশীর সহযোগিতায় তাকে এখানে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন মাদকাসক্ত তরুণীরা জানান, তারা এই পথ থেকে সুস্থ জীবনে ফিরতে চান। কৌতূহলে, ভুল করে তারা মাদকাসক্ত হয়েছেন। এজন্য নিজেদের যেমন সচেতন থাকা উচিত তেমনি অভিভাবকদেরও সচেতন থাকা উচিত বলে মনে করেন তারা।

উল্লেখ্য, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ ও ১৬ ভাগ নারী। সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। তবে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় রয়েছে। মানবজমিন (প্রতীকী ছবি)

পাঠকের মতামত

Comments are closed.