206573

বাংলা সাহিত্যের যে পাঁচটি উপন্যাস না পড়লেই নয়, নোবেল কমিটির জন্যও দুঃখ হয়!

ডেস্ক রিপোর্ট : বাঙালি হিসেবে হয়তো আমাদের গর্ব করার খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, আমাদের যদি গর্ব করার কোন কিছু থাকে তবে সেটি হবে আমাদের সাহিত্য। এই বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যের সংখ্যা অগণিত। বাংলা সাহিত্যের মত বৈচিত্রপূর্ণ ও সুবিদিত সাহিত্য খুব একটা বিশেষ নেই। আমাদের সাহিত্যের যে বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে আমাদের সামনে অনেকেই আমরা তা জানি না কিংবা আগ্রহ করে দেখি না। গত পর্বে বলা হয়েছে এমনই পাঁচ উপন্যাসের কথা, যেই পাঁচটি উপন্যাস এক একটি নক্ষত্র, যারা যুগ যুগ ধরে জ্বলতে থাকবে বাংলা সাহিত্যের আকাশে। আজও তুলে ধরব এমনই আরও কিছু উপন্যাসের কথা।

তেইশ নম্বর তৈলচিত্র – আলাউদ্দিন আল আজাদ
রঙ কিনতে গিয়ে জামিলের সঙ্গে পরিচয় হয় মুখ্য চরিত্র জাহেদের। জামিল জাহেদকে নিয়ে আসে তার বাসার স্টুডিওতে, সেখানেই পরিচয় হয় জামিলের ছোট বোন ছবির সাথে। সেই পরিচয় ধাবিত হয় পরিণয়ের দিকে। ছবির পোর্ট্রেট করতে গিয়ে ছবির চোখে জাহেদ দেখে তার জীবন অন্বেষণের পথ। ছবির সঙ্গে বিয়ের পর হঠাৎ জাহেদের কাছে উন্মোচিত হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য। এই সত্যটি তাদের সম্পর্ককে বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিলেও জাহেদ সে বিপর্যয় রুখে দিয়ে প্রেমকে আরও মহিমান্বিত করেছে তার শক্তিশালী শিল্পী সত্তার সহায়তায়।

উপন্যাসটি শুধু জাহেদের শিল্পী হয়ে ওঠার দার্শনিক বোধ-ভাবনা ও যন্ত্রণার পুঁজিতে গড়ে উঠেছে এমন নয়, বাঙালি সমাজের যুগল প্রেমের সামাজিক মূল্যবোধের বুনিয়াদকে উপন্যাসের নায়ক হিসেবে কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় শিল্পী হিসেবে দাঁড়াবে হাজার বছরের বাঙালি মূল্যবোধে গড়ে ওঠা আমাদের সমাজ এবং শিল্প হবে মানব-মানবীর প্রেম। নায়ক বাঙালি সমাজের বীক্ষণে উপস্থাপিত হয়েছে প্রেম নামক শিল্পের বিচ্ছিন্ন বহু চিত্রে। এসব চিত্রের যোগফল উপন্যাসের কাহিনী এবং এ সবই প্রেমের কাহিনী। আদর্শ ও মূল্যবোধের পরাকাষ্ঠা এ প্রেমচিত্রের শিল্পী খুব স্বাভাবিকভাবেই কাম, ক্রোধ ইত্যাদি রিপুতাড়িত মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব নয় বলে সমাজ-বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয়।

এ কারণেও বলা যায়, প্রেমের এরূপ শিল্পকে বক্তব্যরূপে দাঁড় করিয়ে যে উপন্যাস দাঁড়ায়, একজন মানুষরূপী শিল্পীর পক্ষে সে উপন্যাসের নায়ক হওয়া খুব বাস্তব নয়। শিল্পী আসমানী শক্তিতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ মর্যাদা লাভ করে না। তার অনুভূতিতে ইতিবাচক-নেতিবাচক শক্তির এক প্রচণ্ড আকর্ষণ-বিকর্ষণ থাকে। সেই আকর্ষণ-বিকর্ষণের তীব্রতা যত প্রচণ্ড থাকে, তার বোধ ও অনুভূতিও তত বেশি শাণিত হয় এবং তার শিল্পের অভিব্যক্তিও তত বেশি শক্তিমান হয়। সাধুসুলভ একমুখী পুণ্য ভাবনায় শিল্পী হওয়া সমাজ বাস্তবতা নয়। তাই এ উপন্যাসকে যদি ভাবতে হয়, তাহলে ব্যক্তি জাহেদের পরিবর্তে সেখানে নায়ক শিল্পী হবে আমাদের হাজার বছরের মূল্যবোধের আদর্শ সমাজ। তখন বলা যাবে, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র বাঙালি সমাজের আদর্শ প্রেম শিল্পের এক মহান শিল্পকর্ম।

গণদেবতা – তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়
গণদেবতা উপন্যাসের সময়কাল ১৯২৬ সাল থেকে পরবর্তী আরও একদশক পর্যন্ত বিস্তৃত, যে সময়টা ছিল বড্ড ঘটনাবহুল একটা সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জগৎ, সমাজ, সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনে জ্বলছে শহর, গ্রাম সব। অভাব আর ক্ষুধা মানুষকে পিষে ফেলছে।

বাইরের দুনিয়ার অস্থিরতা থেকে মুক্তি পায়নি কালিকাপুর গ্রাম। অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছে গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনেও। নতুন আর পুরাতনের মধ্যেকার লড়াই দ্বিধাবিভক্ত করে দেয় সরল শান্তিপূর্ণ গ্রাম্য জীবনকে।

অভাবের তাড়নায়, রোজগার আশায় গ্রামের কামার অনিরুদ্ধ থেকে ছুতার গিরিশ সকলে গ্রামের ব্যবসা গুটিয়ে শহরের পথে। এই ধারাবাহিকতায় উত্থান হয় গল্পের নায়ক দেবনাথ ওরফে দেবুর। দেবুর স্ত্রী বিলির জীবনে আমুল পরিবর্তন এলো। এলো অনি কামারের বৌ পদ্মর জীবনে। পাশাপাশি যুদ্ধের বাজারে একদল সুযোগসন্ধানী লোকের আবির্ভাব হল, যারা গরিবের ঘাড়ে পা রেখে তাড়াতাড়ি বড়লোক হয়ে আর মাটিতে পা ফেলতে চাইলো না।

এইসব চরিত্রগুলি নিয়ে গড়ে উঠেছে গণদেবতা উপন্যাস। যেখানে লেখক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় গ্রামের মানুষের জীবনের হঠাৎ বাঁক বদলের কথা সুচারুরুপে ফুটিয়ে তুলেছেন।

শ্রীকান্ত – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
“মরার আবার জাত কি!”

শ্রীকান্ত উপন্যাসের এই সহজ সরল বাক্যটিই মানব গোষ্ঠীর পরম আকর। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে, তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল একটু দেরীতে ১৯২৭ সালে এবং চতুর্থ বা শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। আজকের সময়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় একশ বছর আগে বিশাল আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। সেই কালে সনাতন ধর্মের ভেতরে জাত-পাতের যে বিষাক্ত বিস্তার ছিল, সেই অন্ধকার কালে একটি উপন্যাসের চরিত্রের মুখ দিয়ে এমন সরল কিন্তু চিরকালের একটি মানবিক বাক্য প্রকাশ করাও ছিল দুঃসাহসের পরিচায়ক।

চারটি খণ্ডে প্রকাশিত এই উপন্যাসে অনেক চরিত্র, উপ-চরিত্র, আখ্যান, উপ-আখ্যান তিনি তৈরি করেছেন। এর মধ্যে ইন্দ্র, পিয়ারী বা রাজলক্ষ্মী, অভয়া, গহর, কুমার সাহেব, টগর, রতন, বঙ্কু, কমললতা, ব্রজানন্দ, পুঁটি, নবীন, নন্দ মিস্ত্রি গোটা উপন্যাসে ধানখেতের আইলে আইলে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রতিটি চরিত্র বাঙালি পাঠককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে, এখনও সমানভাবে করছে, ভবিষ্যতেও করবে। একটা উপন্যাস, উপন্যাসের চরিত্র, আখ্যান একশ বছর পরেও পাঠককে আকর্ষণ করে, ধরে রাখে- এমনই জাদুকরি শক্তি এই উপন্যাসের!

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শ্রীকান্তের জীবন-অভিজ্ঞতা বর্ণনাচ্ছলে এতে বিচিত্র ঘটনা ও অসংখ্য নরনারীর সমাবেশ ঘটেছে। সেসব ঘটনা ও পাত্রপাত্রীর বাহুল্যের মধ্যেও উপন্যাসের মূলসূত্র শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রণয়-কাহিনী শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর পাশাপাশি শ্রীকান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথম পর্বের ইন্দ্রনাথ ও অন্নদাদিদি, দ্বিতীয় পর্বের অভয়া, তৃতীয় পর্বের ব্রজানন্দ ও সুনন্দা এবং চতুর্থ পর্বের গহর ও কমললতার হার্দিক ও সামাজিক সম্পর্কের বহু বর্ণিল বিষয় এতে চিত্রিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও একটি বাস্তবানুগ চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। শ্রীকান্ত চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবন বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে বলেই গবেষকগণ মনে করেন।

কপালকুণ্ডলা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
“তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”

“পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”

উপরের উক্তি দুইটি সেই ছোট বেলায় যখন থেকে বাংলা চর্চায় হাতেখড়ি, তখন থেকে শুনে আসছি। কিন্তু আমরা কি জানি উক্তি দুইটি ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি কাব্যধর্মী উপন্যাস থেকে নেওয়া? হ্যাঁ, বলছিলাম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কপালকুণ্ডলা’র কথা, যে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোম্যান্টিক উপন্যাস।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়লে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। স্থানীয় মন্দিরের অধিকারীর সহায়তায় নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে নিজের বাড়ি ফিরে আসেন। পথে মতিবিবি বা লুৎফুন্নিসা নামে এক বিদেশী রমণীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। মতিবিবি বা লুৎফুন্নিসা আসলে নবকুমারের প্রথমা স্ত্রী পদ্মাবতী ছিলেন। পথে নবকুমারকে দেখে তিনি পুনরায় তাকে স্বামীরূপে লাভ করতে উৎসুক হন এবং সপ্তগ্রাম চলে আসেন। পদ্মাবতীর পরিচয় জানার পর নবকুমার তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে কাপালিক কপালকুণ্ডলাকে বধ করতে সপ্তগ্রাম চলে আসে। তার হাত ভেঙে যাওয়ায় সে পদ্মাবতীর সাহায্য চায়।

পদ্মাবতী ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করে কপালকুণ্ডলাকে সব খুলে বলে এবং নবকুমারকে ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করে। ব্রাহ্মণবেশী পদ্মাবতীর সাথে কপালকুণ্ডলাকে দেখতে পেয়ে নবকুমার তাকে ভুল বুঝে খুব কষ্ট পান। আর কাপালিক সুযোগ বুঝে সুরাপান করিয়ে নবকুমারকে উস্কে দিতে থাকেন।

শেষপর্যন্ত নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে উভয়েই জীবনের চরম উপসংহারে উপনীত হয়।

শেষের কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘শেষের কবিতা’ বাংলার নবশিক্ষিত অভিজাত সমাজের জীবনকথা। ব্যক্তি মানুষের মূল্যচেতনার উপাদান যদি অন্তর থেকে শুধুই বার হয়ে আসতে থাকে; যার সমুন্নতি ও দীপ্তি বিদ্যার বৃহৎ পরিমার্জনায়, তারও একটা চরিত্র আছে। বাস্তব চেনাশোনার চলা বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে তা একেবারে অন্তর অভিমুখী। এই নবতর চেতনার অদ্ভুত আবিষ্কার এই উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে। রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত এই পর্বের দুএকটি মুখাবয়বে কল্পনার প্রাধান্য লক্ষণীয়।

বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার অমিত রায় প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং রোমান্টিক যুবক। তর্কে প্রতিপক্ষকে হারাতে সিদ্ধহস্ত। এই অমিত একবার শিলং পাহাড়ে গেল বেড়াতে । আর সেখানেই এক মোটর দুর্ঘটনায় পরিচয় ঘটল লাবণ্যর সাথে। যার পরিণতিতে এল প্রেম। কিন্তু অচিরেই বাস্তববাদী লাবণ্য বুঝতে পারল অমিত একেবারে রোমান্টিক জগতের মানুষ যার সঙ্গে প্রতিদিনের সাংসারিক হিসেবনিকেশ চলে না। ইতিমধ্যে শিলংএ হাজির হয় কেতকী। অমিতের দেয়া আংটি দেখিয়ে অমিতকে নিজের করে নেয়, ভেঙ্গে যায় লাবণ্যর সাথে অমিতের মালা বদলের স্বপ্ন। একসময় অমিতও স্বীকার করে নেয়, লাবণ্যের সাথে তাঁর ভালবাসা ঝর্ণার মতো, পাত্রে করে ঘরে তুলে আনার মতো নয়। কেতকির ভালোবাসাই পাত্রে নিয়ে পান করা সম্ভব। কিন্তু লাবণ্যর প্রতি ভালবাসা বন্য, নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে ঝর্ণার মতো।

নন্দিত নরকে – হুমায়ুন আহমেদ
কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস “নন্দিত নরকে”। লিখেছেন প্রথম পুরুষে। লেখক নিজেকেই বেছে নিয়েছেন উপন্যাসের কাহিনী কথক হিসেবে। উত্তম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসের বলতে গেলে তেমন কোন মুখ্য চরিত্র নেই, এখানে প্রধান হয়ে উঠেছে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনসংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, যৌনতা প্রভৃতি সবকিছুই।

খোকা নিজের ভাষায় তার জীবনের গল্প বলে যায়, তার পরিবারে আছে মাবাবা, কলেজ পড়ুয়া ভাই মন্টু, ছোটবোন তের বছরের রুনু, অপ্রকৃতস্থ বাইশ বছরের বোন রাবেয়া। আরো আছেন হারুন ভাই, নাহার ভাবী, আছেন বাবার বন্ধু মাস্টার কাকা। খোকা এমএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, একটা ভাল চাকুরীর আশায়। সে ভালবাসে তারই প্রতিবেশী শিলুকে। একদিন সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে রাবেয়া! সবাই বুঝতে পারে রাবেয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোন মানুষরূপী নরপিশাচ তার লালসা চরিতার্থ করেছে! কে সে? একদিন খুন হয় মাস্টার কাকা, কে খুন করল তাকে??? নানা অলি গলি পেরিয়ে কাহিনী শেষ ষ্টেশনে এসে থামে একদিন। একদিন ভোর হয়ে আসে, ম্লান জ্যোৎস্না গড়িয়ে যায়। কিন্তু চলতে থাকে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়ার গল্প।

এই উপন্যাসের গল্প ঠিক আমাদের সমাজের দর্পণ! আমাদের দেশে কতশত মন্টু যে আছে, যে নিজের পরিবারের জন্য অন্তপ্রাণ, কত খোকা আছে! শুধু রাবেয়া না, আরও কত মেয়ে মানুষরূপী নরপিশাচের লালসার শিকার তা আমরা জানিও না। জীবনের প্রাত্যহিকতার ও তুচ্ছতার মধ্যেই যে ভিন্নমুখী প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির জটিল জীবনকাব্য তাঁর মাধুর্য, ঐশ্বর্য, গ্লানি, দুর্বলতা, বঞ্চনাবিড়ম্বনা, আর শূন্যতার যন্ত্রণা ও আনন্দিত স্বপ্ন নিয়ে কলেবরে ও বৈচিত্র্যে স্ফীত হতে থাকে, এত অল্প বয়সেও লেখক তাঁর চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে পেরেছেন তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। বিচিত্র বৈষয়িক ও বহুমুখী মানবিক সম্পর্কের মধ্যেই যে জীবনের সামগ্রিক স্বরূপ নিহিত, সে উপলব্ধিও লেখকের রয়েছে। আপাতনিস্তরঙ্গ ঘরোয়া জীবনের বহুমুখী সম্পর্কের বর্ণালি কিন্তু অসংলগ্ন ও বিচিত্র আলেখ্যর মাধ্যমে লেখক বহুতে ঐক্যের সুষমা দান করেছেন। তাঁর দক্ষতা ঐ নৈপুণ্যেই নিহিত। বিড়ম্বিত জীবনে প্রীতি ও করুণার আশ্বাসই সম্বল।

চিলে কোঠার সেপাই – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
সালটা ১৯৬৯… আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু, তাকে মুক্ত করতে উত্তাল গোটা দেশ। এই আন্দোলন ঢাকা থেকে এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজের সর্বত্র জেগে উঠছে এক পরিবর্তনের জোয়ার। সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকেরা এই নতুন প্রেক্ষাপটে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যস্ত, আর শ্রমিক শ্রেণী তখন শোষণহীন সমাজের স্বপ্নে আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আর সবসময় গা বাঁচিয়ে চলা মধ্যবিত্তরা তখন নিজেদের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান। এমনই এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে নিপুণভাবে তুলে ধরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখলেন উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, যা বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের সবথেকে সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস। রাজনীতির নানা ঘটনা পরম্পরা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। সেখানে চিত্রিত হয়েছে, একদল কীভাবে দিনের পর দিন ধরে বিনির্মাণ করে চলেছেন উনসত্তর। আবার তারাই হারিয়ে যাচ্ছেন; এর বিপরীতে উঠে আসে আরেক শক্তি। তারাই প্রবল বেগে প্রভাব বিস্তার করছেন সেই বিনির্মিত উনসত্তরের পাটাতনের ওপর। এর মাঝেও ফুটে উঠেছে মানুষের বৈশিষ্ট্য, চরিত্রের নানা দিক। গল্পে গল্পে এগিয়ে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম।

উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর মনোবিশ্লেষণ। ঊনসত্তর সালের প্রবল গণঅভ্যুত্থানের যারা প্রধান শক্তি ছিল, সেই শ্রমজীবী জনসাধারণ কীভাবে আন্দোলন-পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হলো, বামপন্থীদের দোদুল্যমানতা আর ভাঙনের ফলে, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারার ফলে অজস্র রক্তপাতের পরও রাজনীতির ময়দান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটলো, আওয়ামী লীগ প্রধান শক্তি হয়ে উঠলো, উপন্যাসটির উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুকুই।

একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনৈক অধ্যাপককে বলতে শুনেছিলাম, “নোবেল কমিটির বিচারকগণ বাংলা পড়তে পারেন না। আফসোস! তাঁরা এতো বই মূল্যায়ন করেন, অথচ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটাই পড়তে পারলেন না।”

বাংলা সাহিত্য হচ্ছে রত্নগর্ভা। যুগ যুগ ধরে কত অনন্য, অদ্বিতীয় উপন্যাসের সে জন্য দিয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আজ এ পর্যন্তই, আগামি পর্বে আলোচনা করা হবে আরও সেরা পাঁচ উপন্যাসের।
নিয়ন আলোয়

পাঠকের মতামত

Comments are closed.