206688

পাক সেনার হাত থেকে তথ্য গোপন করতে দরকারি নথি খেয়ে ফেলেছিলেন অভিনন্দন!

অনলাইন সংস্করণঃ- এ যেন একা কুম্ভ! তবে সামনেঘোর বাস্তবের রুক্ষ জমি। পায়ের নীচের যে মাটি তা নিজের দেশের নয়। সামনে দাঁড়িয়ে ভিনদেশি সেনা, পুলিশ , সাধারণ মানুষ। কাজেই তাঁদের পাল্স বোঝা দুষ্কর। তবু তিনি অকুতোভয়। অবিচল। তিনি, পাক ভূমিতে ভেঙে পড়া মিগ ২১ বাইসন যুদ্ধবিমানের চালক উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান।

ইতিমধ্যেই তাঁকে ফেরত দেওয়ার বার্তা দিয়েছে পাক প্রশাসন। শুক্রবারই ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে দেসে ফেরার কথা অভিনন্দনের। কিন্তু ভিন দেশে এই দু’দিন ঠিক কেমন কাটল তাঁর?

পাকিস্তানের দৈনিক ‘ডন’-এর সূত্রে খবর, বিরোধীদের ঠেকাতে শূন্যে গুলি ছোঁড়া, কপ্টারকে বাঁচানোর মরিয়ে চেষ্টা কিছুই বাদ দেননি অভিনন্দন। এমনকি, ধরা পড়ার আগেও দু’-দু’টো পাক কপ্টারকে গুলি করে নামান অভিনন্দন। শুধু তা-ই নয়, পাক জনতার হাতে বন্দি হওয়ার পর খেয়ে ফেলেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর যাবতীয় দরকারি ও গোপন নথিও! যাতে হন্যে হয়ে খুঁজেও তাঁর কাছ থেকে তেমন কোনও দরকারি তথ্য না পায় বিরোধীরা।

শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্ত, আমজনতার পাথরবৃষ্টি— কোনও কিছুই কী ভাবে নিজের দেশের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনীর কর্তব্যের পথ থেকে সরাতে পারল না এই উইং কমান্ডারকে, তা ভেবে অবাক পাক সংবাদমাধ্যমও।

বুধবার মিগ ২১ থেকে পিস্তল-সহ ইজেক্ট হওয়ার পর এটা কোন দেশ তা জানতে চান তিনি। পাক জনতা তত ক্ষণে ঘিরে ফেলেছে তাঁকে। চোখও বাঁধা। তাঁদেরই মাঝে দাঁড়িয়ে বার বার জানতে চাইছিলেন অভিনন্দন, এটা কোন দেশ? ভারত না পাকিস্তান?

ভারতের বায়ুসেনার পেট থেকে কথা বার করতে তখন তাঁকে আশ্বস্ত করা হয় তিনি ভারতের মাটিতেই আছেন বলে। কিন্তু পোড় খাওয়া কমান্ডার অভিনন্দন বোধ হয় তত ক্ষণে বিপদের গন্ধ পেয়ে গিয়েছেন। দেশাত্মবোধক কিছু শ্লোগানের পরেই সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘এটি ভারতের কোন জায়গা?’

এর পর উত্তর আসে ‘এটি কিলান।’ অভিনন্দন তখন ভিড়ের উদ্দেশে জানান, তাঁর কোমর ভেঙে যাচ্ছে যন্ত্রণায়, মিনতি করেন, ‘একটু জল হবে?’ ভারতীয় সেনার জলতেষ্টাও টলাতে পারেনি পাক জনতাকে। বরং তাঁর সামনেই তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশস্তি ও তাদের নামে জয়ধ্বনি শুরু করে দেয় তারা। তত ক্ষণে নিজের অবস্থা বুঝে গিয়েছেন অভিনন্দন। টের পেয়েছেন, তিনি বিরোধী পক্ষের হাতে বন্দি। তবু ওই মুহূর্তেও নিজের কর্তব্য ও আদর্শ ভোলেননি তিনি।

পাক সেনার নামে জয়ধ্বনি শুনেই ফাঁকায় গুলি ছোড়েন অভিনন্দন। নিমেষে উত্তেজিত পাক জনতা পাথরবৃষ্টি শুরু করে ভারতীয় এই বায়ুসেনার উপর। বার বার জানতে চাওয়া হয় তাঁর নাম ও পরিচয়। কিন্তু জেনিভা কনভেনশনের কথা উল্লেখ করে তাঁর সার্ভিস নম্বর ও পদমর্যাদা ছাড়া আর কিছু বলতে চাননি তিনি।

এর পর পরপর আঘাত।তবু তাঁর মুখ থেকে একটা গোপন তথ্যও বার করতে পারেনি ওই জটলা। প্রত্যক্ষদর্শী রজ্জাকের দাবি, পাথর ছুঁড়তে থাকা জনতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বন্দুক তাক করে প্রায় আধ কিলোমিটার পর্যন্ত পিছনের দিকে দৌড়ান অভিনন্দন।

শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক চাপ কোনও কিছুই তাঁকে ঘায়েল করতে পারেনি। শুধু তা-ই নয়, পাক জনতার নৃশংসতার সামনে দাঁড়িয়েওতাদের দিকে একটি গুলিও ছোড়েননি অভিনন্দন। বরং অস্ত্র দিয়ে তাঁদের স্রেফ ভয় দেখিয়ে, ওখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বলে মত ‘ডন’-এর।

পিছনের দিকে দৌড়তে দৌড়তে আচমকাই একটা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। আর সেখানে জলের মধ্যে দাঁড়িয়েই নিজের পকেট থেকে কিছু ম্যাপ, কয়েকটা কাগজ চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন তিনি। তখনই তাঁকে অস্ত্র ফেলে দিতে বলে উত্তজিত পাক জনতা, আর সঙ্গে সঙ্গেই অভিনন্দনের পায়ে গুলি করে তারা।

ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল অভিনন্দনের জেট ক্র্যাশ হওয়ার ভিডিয়ো। তাতেও দেখা গিয়েছিল অত্যাচারের ন্যাক্কারজনক নৃশংসতা। পাক সেনার উর্দি পরা কয়েক জনও সেই ভিড়ে মিশে ছিল।

তাঁদেরই এক জন অভিনন্দনকে তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন ও তাঁদেরই কেউ কেউ তাঁকে আঘাত করছেন। আবার এই উত্তেজিত জনতার মাঝেও পাক সেনার একাংশ জনতার রোষ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে নিজেদের কব্জায় আনার চেষ্টা চালান।

পরে উচ্চপদস্থ সেনা অফিসাররা এসে অভিনন্দনকে নিজেদের হেফাজতে আনেন। এর পরেও তাঁর কাছ থেকে তল্লাশি চালিয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ নথি পায়নি পাক সেনারা। কোনও গোপন পরিকল্পনা বা তথ্যও তাঁর মুখ থেকে বার হয়নি।

অভিনবর এমন বীরত্ব কেবল দেশ জুড়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে এমনই নয়, এমন শৌর্য ছুঁয়েছে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল সিমহাকুট্টি বর্তমান। অভিনন্দনের জীবনের ‘আদর্শ’ এই মানুষটি।

তিনিও গোটা দেশের সঙ্গে প্রার্থনায় বসেছেন, চোখের জল আড়াল করে দাঁতে দাঁত চেপে এই বৃদ্ধটিও এই দু’দিন ধরে আশা করছেন, বিপদ কাটিয়ে সুস্থ শরীরে দেশে ফিরবে অভিনন্দন, তাঁর আদরের পুত্র!

ফিরছেন তিনি। দেশপ্রেম ও বীরত্বের বিপুল উদাহরণ হয়ে ওঠা অভিনন্দনের ফেরার পথ চেয়ে তাঁর বাবা সিমহাকুট্টি বর্তমান। ছেলের দেশপ্রেম আর গর্বিত বাবার এই সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি— এই দুইয়ে ভর করে এ বার অভিনন্দনের দেশে ফেরার পথ চেয়ে তামাম ভারতবাসীও। প্রার্থনাকে উৎসবে পরিণত হতে দেখতে যে আমরা বরাবরই বড় ভালবাসি!

সূত্র আনন্দ বাজার পত্রিকাঃ

পাঠকের মতামত

Comments are closed.