198262

বাচ্চাদের অ্যাজ়মা !

পরিবেশ দূষণের ফলে বাচ্চাদের মধ্যে অনেক সময় হাঁপানি বা অ্যাজ়মার সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার হাত থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করার জন্য রইল কিছু পরামর্শ।

বর্তমান সময়ে যেভাবে দূষণ, ধুলোধোঁয়া প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বহু বাচ্চারই খুব ছোট বয়সে অ্যাজ়মা বা হাঁপানি ধরা পড়ছে। অ্যাজ়মা এক ধরনের রিয়্যাক্টিভ এয়ারওয়ে ডিজ়িজ়, যার কারণে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে যায় এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। খুব ছোট বয়সে অনেক সময়ে বুকে ইনফেকশনের কারণে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। ২ বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একে বলে ব্রঙ্কিওলাইটিস এবং আর একটু বড় বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একে বলা লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (এলআরটিআই) অ্যাসোশিয়েটেড উইথ হুইজ়িং। সাধারণত বাচ্চা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের সমস্যা কমে যায়। একে ঠিক অ্যাজ়মা বলা চলে না। যত ছোট বয়সে এই সমস্যা দেখা দেয়, এটা নিজে নিজেই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। বড় বয়সে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হলে তা অনেক সময়েই থেকে যায়। সাধারণত ৪-৫ বছর এবং তার বেশি বয়সের বাচ্চাদের মধ্যেই অ্যাজ়মার সমস্যা দেখা যায়। পরিবারে কারওর অ্যাজ়মা, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস, এগজ়িমা বা চুলকুনির সমস্যা থাকলে বাচ্চার মধ্যে অ্যাজ়মা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। যদি পরিবারে কারও এই ধরনের সমস্যা না থেকে থাকে, তা হলে সাধারণত সর্দিকাশির সঙ্গে হওয়া শ্বাসকষ্টের সমস্যা একটা বয়সের পর নিজেই কমে যায়। এখানে বলে রাখি, বড়দের ক্ষেত্রে অনেক সময় সর্দি-কাশি ছাড়াও অ্যাজ়মা দেখা দিতে পারে, যাকে বলে ইনট্রিনসিক অ্যাজ়মা। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাধারণত সর্দিকাশির সঙ্গেই অ্যাজ়মা উপসর্গ প্রকাশ পায়। একে বলে এক্সট্রিনসিক অ্যাজ়মা। তবে বাচ্চার কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলেই কিন্তু তা অ্যাজ়মার লক্ষণ নাও হতে পারে। বারবার যদি কাশি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতেই থাকে, তা হলেই ডাক্তাররা একে অ্যাজ়মা বলে থাকেন।

লক্ষণ

শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি অ্যাজ়মার প্রধান লক্ষণ হল ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া, শ্বাস নেওয়ার সময়ে বুকে শোঁ শোঁ শব্দ এবং বুকে অস্বস্তি বা ব্যথা। এর সঙ্গে খুব কাশিও হয়। বাচ্চা ঝিমিয়ে পড়ে, ফ্যাকাশে হয়ে যায়, খেতে চায় না, কথা বলতেও কষ্ট হয়। অ্যাজ়মার তীব্রতা বেশি থাকলে বাচ্চার ঠোঁট, হাতের নখ বা গায়ের রং নীল হয়ে যেতে পারে (সায়ানোসিস)। তবে এটা চরম বাড়াবাড়ি না হলে হয় না। বাড়াবাড়ি হলে ফুসফুসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন পৌঁছয় এবং বাচ্চা একেবারে ঝিমিয়ে পড়ে। আসলে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে যায় বলে ফুসফুসে অক্সিজেন ঠিকমতো ঢুকতে-বেরোতে পারে না। তবে মাইল্ড বা মডারেট অ্যাজ়মার ক্ষেত্রে ফুসফুসে অক্সিজেন স্যাচুরেশনে খুব একটা প্রভাব পড়ে না।

পরীক্ষা

সাধারণত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের মাধ্যমেই অ্যাজ়মা রোগকে চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে অ্যাজ়মাকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব না হলে অন্যান্য কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হতে পারে, যেমন এক্স-রে বা স্পাইরোমেট্রি টেস্ট। খুব ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্পাইরোমেট্রি টেস্ট করা যায় না। ৪-৫ বছর এবং তার বেশি বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই এই টেস্ট করা সম্ভব। এক্স-রে-র সাহায্যে নিশ্চিত হওয়া যায় যে অসুখটা শুধুই অ্যাজ়মা না অন্য কোনও রোগ তার সঙ্গে জড়িত আছে।

চিকিৎসা

যদি বাচ্চার শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয় এবং পরিবারে কারও অ্যাজ়মা, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, এগজ়িমা ইত্যাদি থেকে থাকে, তা হলে ডাক্তাররা প্রথমে সমবুটামল জাতীয় এককালীন ইনহেলার ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এই এককালীন ইনহেলারকে বলে রিলিভার। রিলিভারের সাহায্যে অনেক সময়ে সমস্যা কমে যায়। কিন্তু বারবার শ্বাসকষ্ট হতেই থাকলে শুধু রিলিভারে কাজ হবে না। ঘন ঘন অ্যাজ়মার সমস্যা হলে ডাক্তার ইনহেলড স্টেরয়েড বা মনটেলুকাস্ট জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন, যাতে রোগের ফ্রিকোয়েন্সি কমে। এই কনট্রোলার থেরাপি মোটামুটি মাস তিনেক চালিয়ে যেতে হয়। তারপর আরও তিন মাস বাচ্চাকে ওয়াচে রাখতে হয়। যদি দেখা যায় ওষুধ বন্ধ হওয়ার পরে আবার ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তা হলে পুনরায় থেরাপি শুরু করতে হয়। অনেক সময় ১-২ বছর পর্যন্তও ইনহেলড স্টেরয়েড দেওয়া হয়। রোগী কেমন রেসপন্স করছে সেই অনুযায়ী ওষুধ চালিয়ে যেতে হয়।

মাইল্ড ডোজ়ে স্টেরয়েড দেওয়া হলে সাধারণত কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। তবে মডারেট বা হাই ডোজ়ে স্টেরয়েড দিতে হলে অনেক সময় তা রক্তচাপ, দৃষ্টিশক্তি বা সার্বিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। স্টেরয়েড ব্যবহার করার ফলে মুখে এক ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশনও হতে পারে। তাই স্টেরয়েড দেওয়ার সময়ে বাচ্চাকে নিয়মিত ফলো-আপে রাখতে হয়। যদি দেখা যায় স্টেরয়েডের কারণে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে, তা হলে ডোজ় কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে ওরাল স্টেরয়েডের মতো ইনহেলড স্টেরয়েডে তত ক্ষতি হয় না, কারণ এটা শরীরে পুরোপুরি শোষিত হয় না। ইনহেলারের মাধ্যমে ওষুধ গ্রহণ করলে তা সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছয়, ওরাল মেডিসিনের ক্ষেত্রে যা সত্যি নয়। ওরাল মেডিসিন প্রথমে পেটে যায়, সেখান থেকে রক্তপ্রবাহের সাহায্যে হার্টে পৌঁছয় এবং তারপর হার্ট তাকে পাম্প করে ফুসফুসে পাঠায়। তাই ইনহেলড ওষুধের চেয়ে ওরাল মেডিসিন অনেক বেশি ডোজ়ে দিতে হয়। অ্যাজ়মা যেহেতু ফুসফুসেরই সমস্যা, তাই স্বাভাবিকভাবেই ইনহেলার এক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকরী। অনেকের ধারণা থাকে, ইনহেলার একবার ব্যবহার করলে সারাজীবন ব্যবহার করতে হয়। তবে ইনহেলার কিন্তু একেবারেই হ্যাবিট-ফর্মিং নয়। তবে ইনহেলার অবশ্যই নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা উচিত। ব্রঙ্কিওলাইটিস বা এলআরটিআই অ্যাসোশিয়েটেড উইথ হুইজ়িং-এর চিকিৎসাও ইনহেলার থেরাপি। একে অ্যাজ়মা ভেবে বাবা-মায়েরা অনেক সময়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা ধীরে ধীরে কমে যায়।

বড়দের ক্ষেত্রে ফুড অ্যালার্জি থেকেও অ্যাজ়মার প্রকোপ বাড়তে পারে, তবে বাচ্চাদের সাধারণত ফুড অ্যালার্জি থেকে অ্যাজ়মা হয় না। কিন্তু কোনও বিশেষ খাবার খেলে যদি বাচ্চার শ্বাসকষ্ট বাড়ে, তা হলে সেই খাবারগুলো না দেওয়া উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ফুড অ্যালার্জি সময়ের সঙ্গে সেরে যায়, তাই ৬ মাস বা বছরখানেক পর যদি বাচ্চা সেই খাবার অল্প পরিমাণে খেলে সমস্যা না হয়, তা হলে ধীরে ধীরে তাকে আবার তা দেওয়া যেতে পারে। যদি মনে হয় অ্যালার্জির কারণে সমস্যা বাড়ছে, কিন্তু ঠিক কিসে অ্যালার্জি হয়েছে তা স্পষ্ট না হয়, তা হলে অ্যালার্জি টেস্ট করতে হতে পারে। কারখানার কাছাকাছি থাকার কারণে বা কোনও বিশেষ ফুলের পরাগের সংস্পর্শে আসার কারণেও অ্যাজ়মা বাড়তে পারে। ফিজ়িক্যাল এক্সারসাইজ় করলে অনেকের অ্যাজ়মার সমস্যা বেড়ে যায়, যাকে বলে এক্সারসাইজ়-ইনডিউসড অ্যাজ়মা। এক্সারসাইজ় করার সময়ে আমরা এমনিতেই ঘন ঘন শ্বাস নিই বলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি অবস্থা বুঝে সলবুটামল বা স্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করবেন।

প্রতিরোধ

বাচ্চাকে ৬ মাস পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করান। এতে অ্যালার্জির কবলে পড়ার সম্ভাবনা কমবে। বাচ্চাকে হাইজিন বজায় রাখতে শেখান, মাঝেমধ্যে ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করান। সর্দিকাশি হলে ভেপার নেওয়া, গার্গল করা ইত্যাদিও কার্যকরী। বাচ্চার ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। ঝাড়াঝুড়ি করার বদলে ঘর মুছে নিন। নিয়মিত এসি সার্ভিসিং করান, অপরিষ্কার এসি-র হাওয়া থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে। বাচ্চার ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলো-হাওয়া ঢোকে। বাড়িতে ধূমপান করবেন না। আর ঋতুবদলের সময়ে বাচ্চাকে নিয়ে বেশি বাইরে বেরোবেন না।

source : sananda

পাঠকের মতামত

Comments are closed.