195280

ক্ষমতায় ফিরছেন মাহাথির !

মালয়েশিয়ার উন্নয়নের ইতিহাস লিখতে হলে সেখানে খুজে পাওয়া যাবে একটি নাম, মাহাথির মোহাম্মদ। যিনি ২২ বছর মালয়েশিয়া শাসন করেছেন এবং মালয়েশিয়াকে বদলে দিয়েছেন।

মাহাথির মোহাম্মদের বয়স এখন ৯২। আর এই বয়সে তিনি নির্বাচনে নেমে চ্যালেঞ্জ করছেন তারই সাবেক দল ইউএনএমও’কে।

“আমি বুড়ো হয়ে গেছি”, ভিডিওতে একটি ছোট মালয়ী বালিকাকে বলছেন তিনি। “আমার আর বেশিদিন নেই। দেশকে পুনর্গঠনের জন্য আমাকে কিছু কাজ করতে হবে। কারণ হয়তো আমি নিজেই অতীতে কিছু ভুল করেছি, সেজন্যে।”

মালয়েশিয়ার নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদের প্রত্যাবর্তন এই নির্বাচনী লড়াইকে হঠাৎ যেন আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এটি বিরোধী জোটকেও উজ্জীবিত করেছে। ২০১৫ সালে আনোয়ার ইব্রাহীমকে কারাবন্দী করার পর যে জোট ঝিমিয়ে পড়েছিল।

মালয়েশিয়ার রাজনীতি এবং নির্বাচনে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটছে। মাহাথির মোহাম্মদ যার বিরুদ্ধে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন সেই প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাককে তিনিই নিজের উত্তরসুরি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আর এখন তিনি নাজিব রাজ্জাককে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, সেই আনোয়ার ইব্রাহীমও তার একসময়ের রাজনৈতিক শিষ্য, পরবর্তীতে ঘোরতর রাজনৈতিক শত্রু। তিনি আনোয়ার ইব্রাহীমকে জেলে ভরেছিলেন, সমকামিতার অভিযোগ এনে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ধ্বংসের চেষ্টা করেছিলেন।

মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদের ক্যারিশমা এবং বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একমাত্র বিকল্প নেতা হিসেবে ভাবা হতো আনোয়ার ইব্রাহীমকে। মাহাথির মোহাম্মদ যখন প্রধানমন্ত্রী, আনোয়ার ইব্রাহীম তখন উপ-প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ১৯৯৭ সালে যখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিল, তাদের দুজনের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটলো।

আনোয়ার ইব্রাহীমকে বরখাস্ত করলেন তিনি। তখন আনোয়ার ইব্রাহীম তার নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। কিন্তু মাহাথিরের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ফল তাকে ভোগ করতে হলো। সমকামিতার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, যে অভিযোগ তিনি সব সময় অস্বীকার করেছেন। তাকে জেলে ঢোকানো হলো।

মাত্র ২০১৩ সালেও মাহাথির মোহাম্মদ বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আনোয়ার ইব্রাহীম অনৈতিক জীবনযাপন করেন, তিনি দেশের নেতৃত্ব দেয়ার অনুপযুক্ত।

কিন্তু এখন তিনি কী বলছেন? দুই বছর আগে নিজের দল ইউএনএমও ছেড়ে বিরোধীদের জোটে যোগ দিয়ে মাহাথির মোহাম্মদ এখন মনে করেন, “তরুণ বয়সে আনোয়ার কিছু ভুল করেছেন, তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি তিনি পেয়েছেন।”

“আমাদের এক সঙ্গে কাজ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আনোয়ারের পরিবার আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে যাতে আমরা নাজিব রাজ্জাককে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারি।”

মাহাথিরের এই বাড়িয়ে দেয়া বন্ধুত্বের হাত কিভাবে নিচ্ছে আনোয়ার ইব্রাহীমের পরিবার? তারা মনে করে বিরোধীদের এখন এ রকম একটা ব্যাপক ভিত্তিক জোটের দরকার আছে, দরকার আছে মাহাথিরের উচ্চতার একজন নেতার।

আনোয়ার ইব্রাহীমের কন্যা নুরুল নুহা বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে হয়তো ব্যাপারটা খুব কষ্টের। কিন্তু আপাতত আমরা সেটা পাশে সরিয়ে রাখতে চাই। এটি মালয়েশিয়ার ভবিষ্যতের ব্যাপার।”

কিন্তু ৯২ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ কি পারবেন তার সাবেক শিষ্য নাজিব রাজ্জাককে ক্ষমতাচ্যূত করতে?

জনসভার মঞ্চে তার আবেদন এখনো আগের মতোই। জনতাকে উজ্জীবিত করতে পারেন তিনি। এই বয়সেই টানা আধ ঘন্টা বক্তৃতা দিতে পারেন দুপায়ে দাঁড়িয়ে। তার বক্তৃতায় তিনি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাককে। কথিত দুর্নীতি এবং জাতীয় সম্পদের অপচয়ের জন্য কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।

“আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী যে তাকে আমিই পদোন্নতি দিয়ে এই পর্যায়ে তুলে এনেছি, এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”

মাহাথিরের সঙ্গে নাজিব রাজ্জাকের তফাৎটা চোখে পড়ার মতো।

জনসভায় নাজিব রাজ্জাকের বক্তৃতা অতটা চিত্তাকর্ষক নয়। তিনি জনতাকে সেভাবে উজ্জীবিত করতে পারেন না। কিন্তু শক্তিশালী কিছু বাড়তি সুবিধা তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।

মালয়েশিয়ার নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন হওয়ার কথা। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্য ছয় জন বিরোধী নেতাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেছি কিছু প্রশ্ন সাপেক্ষ ‘টেকনিক্যাল’ ইস্যুতে। পোস্টাল ব্যালটের অপব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কেন সপ্তাহান্তে না করে সপ্তাহের মাঝখানে ফেলা হলো, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মালয়েশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে মালয়ীরা। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ এদের মধ্যেই। যদিও ভারতীয় এবং চীনা বংশোদ্ভূতদের মধ্যেও কিছু গরীব আছে। ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে মালয়েশিয়ার যে নাটকীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সেটার কৃতিত্ব দাবি করে নাজিব রাজ্জাকের দল ইউএনএমও।

নির্বাচনী সভায় নাজিব রাজ্জাক একথা মনে করিয়ে দেন যে তার দলই মালয়েশিয়ায় মালয়ীদেরকে বিশেষ মর্যাদার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তিনি প্রকারান্তরে এমন ইঙ্গিতও দিচ্ছেন যে বিরোধীদের ভোট দেয়া মানে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টিকে ভোট দেয়া, যারা মূলত এথনিক চীনাদের দল।

এ ধরণের বক্তব্য মালয়েশিয়ার বহুজাতিক সমাজে জাতিগত বিভেদকে উস্কে দিতে পারে। ২০১৩ সালে এথনিক চীনাদের প্রায় সব ভোট পড়েছিল বিরোধীদের বাক্সে। কিন্তু মালয়ীরা যেখানে মোট জনসংখ্যার ষাট শতাংশ, সেখানে নির্বাচনী ফলটা তাদের ভোটেই নির্ধারিত হবে। আর এ কারণেই বিরোধীরা এখন জোট বেঁধেছে মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে, যিনি এই ভোট আকর্ষণ করতে পারবেন।

নাজিব রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বিরোধীদের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র দুর্নীতির অভিযোগ। একটি সরকারী বিনিয়োগ তহবিলের শত শত কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার সরকারের বিরুদ্ধে। এর মধ্য প্রায় ৭০ কোটি ডলার নাকি সরাসরি নাজিব রাজ্জাকের ব্যক্তিগত একাউন্টে রাখা হয়েছিল।

নাজিব রাজ্জাকের স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবন-যাপন, মালয়েশিয়ার অর্থনীতি, বিনিয়োগের প্রতি চীনা হুমকি, এসবকেও ইস্যু করছে বিরোধীরা।

কিন্তু তারা কি পারবে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় ইউএনএমও’র ৬১ বছরের নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাতে?

শেষ প্রশ্নের শেষ জবাব জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৯ মে বুধবার নির্বাচন পর্যন্ত।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.