189506

ঢাকাইয়া মুভির সতেরো সাল ও হাজির বিরিয়ানি!

 

ডেস্ক রিপোর্ট : মুভি কথাটা শুনলেই আমার স্মৃতির ফিতা পেছন দিকে ঘুরতে থাকে। জীবনে প্রথম যে বাংলা ছবি দেখে পুরোটা বুঝি, সেটা রাজ্জাক অভিনীত ‘রংবাজ’। বয়স তখন ১০ কি ১১। বড় ভাইয়ের ডানপিটে বন্ধু ‘রংবাজ’ দেখে এসে ভয়াবহ মুভিটির বর্ণনা দেন। দোকানে সিগারেট আগে নেওয়া নিয়ে রাজ্জাক-জসীমের ফাইট নিজেই করে দেখালেন। উত্তেজিত হলাম। আম্মাকে আবদার ধরায় পুরো পরিবার মিলে রংবাজ দেখা হল। আমার ইংলিশ মুভির হাতেখড়ি ক্যাডেট কলেজপড়ুয়া বড় ভাইয়ের কাছে। ছুটিতে এসে অভিসার হলে ‘স্ম্যাশিং দ্য ক্রাইম সিন্ডিকেট’ নামে একটা অ্যাকশন মুভি দেখালেন। বাংলা মিডিয়ামে পড়ি। ডায়ালগ বুঝিনি, গল্প বুঝলাম। ভালো লাগল। আর হিন্দি মুভি প্রথম দেখি বন্ধুদের সঙ্গে। পুরান ঢাকার আমলিগোলার এক চিপা গলির আলো-আঁধারি ঘরে ১০ টাকার টিকিটে ভিসিআরে দেখলাম ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। শুরু হলো আমার সিনেমা হলে নিয়মিত যাতায়াত।

গত শতকের শেষ দিক পর্যন্ত ঢাকা শহরে মুভি দেখা ছিল নাগরিক বিনোদনের প্রধান খোরাক। আনন্দ থেকে মধুমিতা, বলাকা থেকে গুলিস্তান আর অভিসার, নাগরমহল থেকে রূপমহল, সবখানেই দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। শুক্রবারে সিনেমা হলগুলোয় ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ নোটিশ লেখা আর ব্ল্যাকারদের টিকিট হাতে ‘অই রিয়াল (রিয়ার) স্টল-রিয়াল স্টল’, ‘ডিসি ডিসি ডিসি’ চিৎকার ছিল কমন। ভদ্রলোকেরা মুভি দেখত। বাংলা হোক আর ইংলিশ হোক, ভালো মুভি হতো। বাংলা মুভি দেখার মতো ছিল।

কমার্শিয়াল মুভি ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে সর্বাধিক বাণিজ্যসফলতার তকমা জুটিয়েছিল। কলকাতায় তার রিমেক হয়েছিল। তারও আগে পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্ল্যাসিক মুভি রিনি রেজা অভিনীত ‘সুপ্রভাত’ বা বুলবুল আহমেদ-জয়শ্রীর ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিগুলোও ছিল ব্যবসাসফল, দর্শকনন্দিত।

হলিউডের তাজা তাজা ক্ল্যাসিক মুভি ঢাকায় রিলিজ পেত। পল নিউম্যানের ‘দ্য টাওয়ারিং ইনফারনো’, সোফিয়া লরেনের ‘টু উইমেন’, ‘সানফ্লাওয়ার’সহ ক্ল্যাসিক ইংলিশ মুভিগুলো ঢাকায় আসত প্রতি সপ্তাহে। ওগুলো মূলত চলত মধুমিতা আর অভিসার হলে। মজার বিষয়, ইংলিশ মুভিগুলো রিকশাচালক—সবাই দেখত। হলিউড মুভিতে বেড সিন বা সি-বিচের উত্তেজক দৃশ্য থাকত। ‘সানফ্লাওয়ার’ মুভিতে সোফিয়া লরেন আর মারসেলো মাস্ত্রোয়ানি অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেয়েছিলেন। পর্দায় অরেঞ্জ ক্রাশ বা কোকাকোলার বিজ্ঞাপনে বোতল হাতে বিকিনি পরা মেয়েরা বিচে দৌড়াত। ভাবলাম, আমজনতা বোধ হয় এগুলো দেখতে যায়। ভুল ভাঙল। ‘টু উইমেন’ ছবিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে দুধের বাচ্চা কোলে ক্ষুধার্ত মা যখন উন্মুক্ত স্তন দেখিয়ে চিৎকার করে ইংলিশে বলছে, ‘আমার বাচ্চার খাবার নেই,’ তখন ইশ্‌ করে সবার সঙ্গে সঙ্গে আমজনতাও চোখের পানি ফেলেছে। বুঝলাম, স্তন বা বিকিনি না, গল্প দেখতে আসে তারা।

বাংলা সামাজিক ছবিগুলোও বক্স অফিস হিট হতো। ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাভ ইন সিমলা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘দ্য ফাদার’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘অনন্ত প্রেম’-জাতীয় শত শত সামাজিক ছবি সারা সপ্তাহ হাউসফুল থাকত। বাংলা অ্যাকশন মুভি দুই ধরনের হতো—ডিটেকটিভ বা ওয়েস্টার্ন আদলে আর ফ্যান্টাসি বা রূপকথার আদলে। ওয়েস্টার্ন আদলের একটি লিজেন্ড বাংলা মুভি হচ্ছে ‘দোস্ত দুশমন’। এটা ওপেন সিক্রেট ছিল যে ‘দোস্ত দুশমন’ ভারতের ‘শোলে’ মুভির বাংলাদেশি সংস্করণ। কিন্তু অনেকেই জানে না যে ভারতের নির্মাতারা ‘শোলে’ মুভির থিমটি নিয়েছিলেন হলিউডের ওয়েস্টার্ন মুভি ‘বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সান্ড্যান্স কিড’ থেকে। হলিউডের এই মুভিটি ঢাকার মধুমিতা আর অভিসার হলে চলেছিল।

বাংলা বাণিজ্যিক মুভির আরেকটি জনপ্রিয় ধাঁচ ছিল রূপকথা-লোকগাথা বা কল্পকাহিনিভিত্তিক। এসব মুভির কাহিনিগুলো রাজা বাদশাহ-প্রজাদের ঘিরে আবর্তিত হতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নায়ক থাকত নির্যাতিত কোনো গরিব প্রজার সন্তান আর নায়িকা জমিদার বা রাজার মেয়ে। গ্রাম বা মফস্বলে এই মুভিগুলোর চাহিদা ছিল ভীষণ। লোকগাথাভিত্তিক মুভির একটা বড় ও আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সাপ। গোখরা সাপের ফণা বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশে বিশাল অবদান রেখেছে। আর দর্শকের রগ ধরতে পারা মেধাবী নির্মাতারা সুকৌশলে সাপের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন বেদেনীকে। বেদেনীরা স্বল্পবসনা আর সেজেগুজে থাকে। নির্মাতা বেদেনীকে মূল চরিত্র করে নাচালেন বিভিন্ন মুদ্রায়। সাপের তালে তালে কোমরে বিছা পরে উদ্দাম নাচলেন আবেদনময়ী বেদেনী। সাপ-বিছা মিলে পর্দায় তুলল পাগলা মুদ্রা।

‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ বাংলার লোকগাথা কাহিনি নিয়ে হলেও তা হিট করার মূল কারণ ছিল অঞ্জু ঘোষ নামের এক নতুন নায়িকার আবির্ভাব। ভারী শারীরিক গঠন আর নাচের চমৎকার মুদ্রাজ্ঞান তাঁকে করে তোলে এক ধূমকেতু নায়িকা। অতি সাধারণ দর্শকের কাছে ‘সেক্স সিম্বল’! যাঁরা চোখ ছোট করে সবকিছু দেখেন, তাঁরা একটি জিনিস মার্ক করলেন, এ দেশের অতি সাধারণ মুভি দর্শক একটু ভারী শারীরিক গঠনের নায়িকা পছন্দ করে। সাধারণ দর্শকদের কাছে শাবানা ছিলেন ভীষণ প্রিয়। অভিনয়ে তেমন তীক্ষ্ণ না হয়েও ভারী গঠনের অলিভিয়া ছিলেন বাড়তি আকর্ষণীয়। এবার এলেন অঞ্জু ঘোষ।

‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার নিচে ছিল। কিন্তু ছবির নাম যখন ‘গরম মসলা’, ‘নরম গরম’ হতে লাগল, গান চাকভুম চাকভুম থেকে তালগাছের এক খাম্বার দিকে গেল, পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে গেল। বিভিন্ন নির্মাতা ঝুঁকে পড়েন অল্প লগ্নিতে বেশি লাভের এক নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে। সাধারণভাবে একে বলা হলো ‘অশ্লীল চলচ্চিত্র’। উদয় ঘটলো একঝাঁক অশ্লীল ছবির নায়িকার। এই নায়িকারা থাকলেই মানুষ বুঝে নিত, ছবির মধ্যে নরম, নাকি গরম মসলা আছে। মার খেতে থাকে সুস্থ ধারার সামাজিক ও কমার্শিয়াল ছবিগুলো।

এঁদের দাপটে অভিনয় প্রতিভার নায়ক-নায়িকারা হয়ে গেলেন রিফিউজি।

ঠিক তখনই বাংলা মুভিতে ধূমকেতুর মতো উদয় হয় একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল নতুন মুখের অভিনেতা-অভিনেত্রী। মৌসুমী, সালমান শাহ, শাবনূর, ওমর সানী, শাকিল খান, শাকিব খান, রিয়াজ, শাবনাজ, ফেরদৌস, পপি, পূর্ণিমারা। সামাজিক, কমার্শিয়াল ছবির নির্মাতাদের হাত ধরে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করে বসলেন অশ্লীল ছবিকে। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘হঠাৎ বৃষ্টি’, ‘মনের মাঝে তুমি’সহ অনেক সুস্থ ধারার সামাজিক ছবি দর্শকদের নতুন আশার হাতছানিতে ডাকতে থাকে। অশ্লীল ছবিকে পাশ কাটিয়ে রুচিশীল দর্শক আবারও ঢুঁ মারতে লাগে সিনেমা হলগুলোয়। চেষ্টা চালালেন জনপ্রিয় নাট্যকার-নির্মাতা হ‌ুমায়ূন আহমেদও। চেষ্টা চালান তারেক মাসুদরা। নতুন প্রজন্মের এই অভিনেতা-অভিনেত্রী-নির্মাতারা লেগে থেকেছেন এক যুগেরও বেশি। কিন্তু নির্মাতারা পেরে উঠছিলেন না। কারণ, শুধু অশ্লীল ছবিই না, দর্শকেরা এরই মধ্যে মুম্বাই ছবির স্বাদ পেয়ে গেছে। বিগ বাজেটের মুম্বাই ছবির কাছে হার মানতে লাগলেন দেশীয় নির্মাতারা। গল্পের সংকট আর বলিউডের ‘তিন খান’-এর সুইট আক্রমণে কোণঠাসা হলো দেশীয় চলচ্চিত্র।

এদিকে ইংলিশ ছবিও বসে থাকেনি। অশ্লীল ইংলিশ ছবির ধাক্কায় বহু আগেই হলিউড ঢাকা ছেড়ে ভেগেছে। এর জায়গায় হংকং-চায়না থেকে এসেছে কম দামি কুংফু মার্কা ছবি, যার মধ্যে আছে কেটে লাগানো সফট আর হার্ড পর্নো। নাম দেওয়া হলো কাটপিস। মানুষ কাটপিস কাপড় কিনত, এখন সিনেমা হলে কাটপিস দেখে।

ভদ্র, সাধারণ দর্শক সিনেমা হল থেকে সরে গেলেন।

সবকিছুর শেষ আছে। অশ্লীল ছবিও আকর্ষণ হারায়। কিন্তু ততক্ষণে সুস্থ ছবির নির্মাতারা হারালেন উৎসাহ আর সক্ষমতা। সিনেমা হলগুলোকে পোড়ো বাড়ির মতো লাগতে লাগল। হল মালিকেরা লাগাতার লোকসান গুনতে লাগলেন। সিনেমা হলগুলো একে একে ভেঙে মার্কেট হয়। খোদ ঢাকা শহরের মল্লিকা হল মার্কেট হয়ে যায়।

মাঝখানে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। কিছু টিভি চ্যানেলের প্রযোজনায় ছবির উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো মুভির মানে খুব একটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে সে উদ্যোগ অন্তত মুভি কনসেপ্টকে চালু রেখেছে। ঢাকাইয়া ভাষায় একে বলে তাওয়া গরম রাখা। তাওয়া গরম রেখেছিলেন অনন্ত জলিল। যে যতই ঠাট্টা-মশকরা করুক, অনন্ত জলিল শুধু তাওয়াই গরম রাখেননি, আশপাশে চুলোও জ্বালিয়েছেন। সে চুলাগুলো হচ্ছে উজ্জীবিত নতুন কিছু মুভি নির্মাতাদের উদ্যোগ।

২০১৭ সালে সেই চুলোগুলো জ্বলেছে। নতুন কিছু বাংলা মুভি হঠাৎ করে উৎসাহিত করেছে নতুন প্রজন্মের দর্শকদের। সিনেমা হলে আবার গিয়েছে দর্শকেরা। এটি বাংলা মুভির জন্য একটি আশা জাগানিয়া বছর। কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন, কোন কোন ছবি তাদের কাছে বড় পর্দায় নাটক মনে হয়েছে। আবার কোন কোন ছবিকে দর্শক অতি আতলামি মনে করেছে। আবার কোন কোন ছবির ভূয়সী প্রশংসাও হয়েছে। এগুলো হবেই। এগুলোই প্রেরণা। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এবার যেন দর্শক বিরক্ত হয়ে আর ফেরত না যায়। নির্মাতাদের মুভির ভাষা ও দর্শকের রগ ধরতে জানতে হবে। ভুললে চলবে না, মুভির কনটেন্ট বা গল্প একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নইলে চার দশক পরও মানুষ সাদা-কালো ঝিরঝিরে ফিতার ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ দেখে কেন?

একটা চমকানোর খবর দিই। বহু বহু আগে সাদা-কালো যুগে বাংলাদেশে ‘ত্রিরত্ন’ নামে একটা কমেডি মুভি হয়েছিল। যদি বলি মুম্বাইয়ের ‘থ্রি ইডিয়টস’ আমাদের সেই ‘ত্রিরত্ন’ দিয়ে প্রভাবিত? হাসবেন না, শুনে রাখেন। শুধু নামেই মিল না, ‘ত্রিরত্ন’ ছবিতে তিন অভিনেতা বরপক্ষ সেজে এক বিয়েবাড়িতে ফলস বিয়ে খেতে ঢুকেছিল, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিতে হুবহু সেই রকমের একটা দৃশ্য আছে। এই ছবির ‘অল ইজ ওয়েল’ গানটি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ মিউজিক ভিডিওর অলমোস্ট জেরক্স কপি বা নকল। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের রুনা লায়লার ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’ গানের হুবহু সুরে বহু বছর আগেই মুম্বাইয়ে অমিতাভ বচ্চন ‘দে দে পেয়ার দে’ হিট গানটি গেয়েছিলেন!

বিশ্বিবদ্যালয় শেষ করার পর নয়াবাজারে এক সাদা লুঙ্গি পরা ঢাকাইয়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়। ব্যবসার বুদ্ধি নিতে গেছি। শালপাতায় মোড়ানো টেক অ্যাওয়ের হাজির বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। খেতে খেতে ভদ্রলোক বললেন, ‘হুনেন, হাজির মাল পাতায় খিলেন আর স্বর্ণের থালায় ভি খিলেন, জিনিস ঝাক্কাস। মাল-মসলাই আসল। মনে রাইখেন, খাঁটি মধু ছিটাইলে মাছি ভনভনাইবোই!’

বাংলা মুভির হাজি সাব বা মধুওয়ালারা কি আছেন? অবশ্যই আছেন। তাঁরা উঁকি দিচ্ছেন। মুভিটা হাজি সাব বা খাঁটি মধুওয়ালার হাতে পড়ে গেলে গাছের পাতায়ই দেন আর স্বর্ণের থালায়ই দেন, জিনিস হবে ঝাক্কাস। আর তা যেখানেই চালান, মাছি থুক্কু দর্শক আসবেই।

সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট হয়েছে? ঘাবড়াবেন না। মুভির হাজি সাব আর মধুওয়ালাদের হাতে মুভি চলে গেলে আবার সেই মার্কেটগুলোতেই একটা করে সিনেমা হল হবে। সূত্র প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

Comments are closed.