179088

তিন লাখ বিদেশি নাগরিক আসছে করের আওতায়

শায়েখ হাসান: বাংলাদেশে কর্মরত প্রায় তিন লাখ বিদেশি নাগরিককে করের আওতায় আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে এদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেস তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরেই এসব নাগরিকদের বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের সঠিক তথ্য সরকারের কোনো বিভাগের হাতেই ছিল না। তবে পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, দেশে বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ২ লাখ ২১ হাজার ৫৫৯ জন। যদিও অবৈধ বিদেশির সংখ্যা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে এই সংখ্যাটি নিরুপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

এনবিআর কর্মকর্তারা আরো বলেন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, মাত্র ১০ হাজার ৮৫ জন বিদেশী নাগরিক সরকারি কোষাগারে আয়কর জমা দেন। অর্থাৎ অধিকাংশ বিদেশি নাগরিক দিনের পর দিন বেপরোয়াভাবে কর ফাঁকি দিচ্ছেন। তবে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের কর ফাঁকি শূন্যে নামিয়ে আনতে চায় সরকার।

কর ফাঁকি ঠেকাতে গঠন করা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স। দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একটি স্থলবন্দরে বসানো হয়েছে আয়কর চেকপোস্ট, বসানো হয়েছে দুটি আয়কর গোয়েন্দা সেল। এর বাইরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে তিনটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ, এফবিসিসিআই, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও রয়েছে।

সমন্বিত ভাবে কাজ করার মাধ্যমে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে এনবিআর। চূড়ান্ত ফলাফল ও প্রস্তাবনা দেওয়া হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে। তার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সংখ্যক বিদেশী নাগরিকদের উপর করারোপ করতে যাচ্ছে সরকার।

এনবিআর-এর বিশেষ টাস্কফোর্সের হাতে এমনও তথ্য এসেছে যে, খ্যাতনামা একটি তৈরি পোশাক শিল্পের উচ্চপদে কর্মরত শ্রীলঙ্কার এক নাগরিক। বেতন পাচ্ছেন প্রতি মাসে সব মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার বেশি। আছে আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তিনি আয়কর রিটার্নে বেতন দেখিয়েছেন মাসে মাত্র ৮০ হাজার টাকা। অথচ তার অধীনস্থদের কয়েকজনই বেতন পান ২ লাখ টাকার ওপরে। পরে হিসাব নিয়ে দেখা গেছে, তিনি বছরে আয় করেন ৬০ লাখ টাকার বেশি। আবার অনেক বিদেশী আছেন যারা উচ্চ বেতনে চাকরি করলেও রিটার্ন দেন না।

শুধুমাত্র সংখ্যা নির্ধারণ নয়, এ ধরনের অসঙ্গতি-অনিয়মও দূর করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে বছরের প্রথমদিকে কর ফাঁকিবাজ বিদেশীদের ধরতে বিশেষ টাস্কফোর্স সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন কর অঞ্চলের ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়। যেখানে উচ্চ বেতনে অনেক বিদেশী কাজ করছেন সেসব প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন অভিযান চালানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বিদেশী নাগরিক কর্মরত রয়েছেন- এমন সব প্রতিষ্ঠানকে অভিযানের আওতায় আনা হবে বলে টাস্কফোর্স সূত্র জানিয়েছে।

এমনকি এসব বিদেশীদের সংখ্যা নির্ণয়ের পর করারোপের পর তারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন কী না, তা তদারকির দায়িত্বও এই বিশেষ টাস্কফোর্সকে দেওয়া যায় কি না, তা ভাবা হচ্ছে বলেও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের কাছ থেকে সঠিকভাবে আয়কর আদায় করতে গত বছর একটি টাস্কফোর্স গঠন করে এনবিআর। এর সদস্য হিসেবে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), পুলিশের এসবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেপজা, পাসপোর্ট অধিদফতর, এনজিও ব্যুরো ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিদের রাখা হয়। পরে কাজের সুবিধার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলভিত্তিক টাস্কফোর্সকে ভাগ করা হয়। ঢাকা অঞ্চলের টাস্কফোর্স ১২ সদস্য নিয়ে গঠিত। এই টাস্কফোর্সই মূলত বিদেশীদের ডাটাবেজটি তৈরির কাজ করছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে কত বিদেশী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই। সে হিসেবে টাস্কফোর্স চূড়ান্তভাবে সংখ্যাগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের পরামর্শ নেবে।

তবে টাস্কফোর্সের অংশ বিভিন্ন সংস্থার কিছু তথ্য প্রায় কাছাকাছি ধরনের। যেমন, অধিকাংশ বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে ট্যুরিস্ট ভিসা ব্যবহার করেন। এরপর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। আবার বিভিন্ন কোম্পানির ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আসা, বিশেষ করে এনজিও, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গার্মেন্ট, মার্চেন্ডাইজিং, পরামর্শকসহ বিভিন্ন পদে কর্মরত বিদেশীদের বেতন-ভাতা গোপন রাখা হচ্ছে। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ কৌশল অবলম্বন করছে দেশীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি গোপন চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাচার হচ্ছে। প্রতি বছরই মুদ্রা পাচারের পরিমাণ আশংকাজনক হারে বাড়ছে। এছাড়া অবৈধভাবে আসা বিদেশীরা মাদক চোরাচালান ও জাল মুদ্রা ব্যবসার মতো অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আবার অনেক বিদেশী নাগরিক অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে দেশে প্রবেশের পর ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলছেন। ফলে তাদের খুঁজে বের করা যায় না।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত বিদেশীরা সঠিকভাবে ট্যাক্স দিচ্ছেন কিনা তা খতিয়ে দেখতে অভিযান চালাবে টাস্কফোর্স। অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশী কর্মীদের কর ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করছে। বেতন গোপন করে কর্মীদের হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করছে। এটা মানি লন্ডারিং অপরাধ। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে আয়কর আইনের আওতায় জরিমানা করা হবে। এর আগে টাস্কফোর্স বাংলাদেশে আগত বিদেশীদের মনিটরিং করতে এন্ট্রি লেভেলের স্পন্সরের বিধান চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ কোনো বিদেশীকে কাজের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের আগে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের স্পন্সরকারী হিসেবে নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ বিস্তারিত উল্লেখ করার বিধান চালু করে। সরকারি অনেক সংস্থাই এসব বিধান মানছে না।

ইতিমধ্যে টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের জুলাই থেকে ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একটি স্থলবন্দরে আয়কর বুথ খুলেছে এনবিআর। ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আয়কর বুথে দায়িত্বে সহকারী কর কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পদায়ন করা হয়েছে। এসব বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে অবশ্যই বিদেশীদের আয়কর প্রত্যয়নপত্র দেখাতে হচ্ছে। প্রত্যয়নপত্র দেখাতে না পারলে বিদেশ গমনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।

এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশীদের করের আওতায় আনতে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। ১৬৫সি ধারায় বলা হয়েছে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া হলে কর্তৃপক্ষকে সর্বনিু ৩ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান চালু করা হয়।

বিদেশি নাগরিকদের আয়কর বিষয়ক স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব ও এনবিআরের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস, লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদেশি নাগরিকদের কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর ফাঁকি রোধে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গঠিত টাস্কফোর্স দু’টি মূলত মাঠপর্যায়ে কাজ করবে।

তিনি জানান, টাস্কফোর্স দু’টি এরই মধ্যে সম্ভাব্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত বিদেশি কর্মীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এজন্য একটি সফটওয়্যারও এরই মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিদেশিদের আগমন ও বহির্গমনের সব তথ্য এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হবে।

তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে মধ্যে বিদেশি নাগরিকদের এই তথ্যভাণ্ডারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, পাশাপাশি করের আওতায়ও আনা সম্ভব হবে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.