173699

শাজাহান খানের প্রমোশন চাই

শাজাহান খানের কর্মতৎপরতায় আমি মুগ্ধ, অভিভূত। আমি মাঝে মাঝে তার পোর্টফোলিও ভুলে যাই, বিভ্রান্তি ঘোচাতে তালিকা ঘেঁটে দেখি তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। ধন্দে পড়ে যাই নৌ পরিবহন মন্ত্রীর তো পিনাক-৬ নিয়ে ঘুম হারাম থাকার কথা। তিনি কিনা পাঁচ তারকা হোটেলে বসে তাজরিনের ১১১ জনের খুনী দেলোয়ারের সাথে তোবা সমস্যা সমাধানে বৈঠক করেন। তাই বিভ্রান্তি ঘোচাতে নিজের সাথেই নিজের আলাপন।
:গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে নৌ-পরিবহনের কী সম্পর্ক?
: কোনও সম্পর্ক নেই। শাজাহান খান শুধু একজন মন্ত্রী নন, তিনি গার্মেন্টস শ্রমিকদের নেতাও।
: আরে ভাই, আমি তো জানতাম তিনি পরিবহন শ্রমিকদের নেতা। তিনি আবার কবে কোন গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে যোগ দিলেন? আর তিনি নেতাই বা হলেন কবে ?
: না ভাই, এত কম জানলে আপনাদের সাথে কথা বলাই মুশকিল। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নেতা হতে হলে গার্মেন্টস শ্রমিক হতে হবে বা পরিবহন শ্রমিকদের নেতা হতে হলে পরিবহন শ্রমিক হতে হবে, এমন কথা কোথায় লেখা আছে? এই যে তোবার শ্রমিকদের পাওনা আদায়ে আন্দোলন করছেন আপনাদের প্রিয় মিশু আপা। উনি কোন গার্মেন্টসের শ্রমিক? সেই প্রশ্ন তো কখনও করতে দেখি না। খালি শাজাহান খানের পেছনে লাগতে আসেন। আপনারা ছোটবেলায় ভালো খাবারদাবার খান নাই বলে আপনাদের স্মৃতিশক্তি কম। শাজাহান খান মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রীতিমত সম্মেলন করে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক হয়েছেন। তাই তার গার্মেন্টস শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে পাঁচ তারকা হোটেলে বসে দালালি করার পূর্ণ অধিকার আছে।
:ভাই ধন্যবাদ। বুঝলাম। কিন্তু শাজাহান খান গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা হলে পরিবহন শ্রমিকদের কী হবে ?
:আপনার সাথে আলাপ চালিয়ে যাওয়া সত্যি মুশকিল। উনি পরিবহন সেক্টর ছেড়েছেন কে বললো? এটা ওনার মূল জায়গা। আয়ের প্রধান উৎস। পরিবহন সেক্টর হলো সোনার খনি, কাঁচা টাকা। এটা ছাড়বেন কেন? উনি না থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে ড্রাইভারদের দালালি করবে কে? গরু-ছাগল চিনলেই অশিক্ষিত হেলপারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার তদবির করবে কে?
:বুঝলাম। তার মানে উনি একাধারে নৌ পরিবহন মন্ত্রী, পরিবহন শ্রমিক নেতা এবং গার্মেন্টস শ্রমিক নেতাও। কিন্তু আওয়ামী লীগে এত লোক থাকতে ওনার এত দায়িত্ব কেন? আর উনি এতকিছু পারেন কিভাবে ?
: যাদের জাসদ করার অভিজ্ঞতা আছে, তারা একটু বেশিই পান, বেশিই পারেন। এই দেখেন আওয়ামী লীগের এত জাঁদরেল নেতা থাকতে সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

: শুনলাম পিনাক-৬ এ নৌ পরিবহন মন্ত্রীর তিন ভাগ্নীও ছিলেন। আল্লাহ তাকে শোক সইবার ক্ষমতা দিক। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে না হোক, স্বজন হিসেবেও তো তার এখন পদ্মার পাড়ে থাকার কথা। সোনারগাঁও হোটেলে মিটিং করেন কিভাবে?

: ভাই এত ছোটখাটো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শোক নিয়ে পড়ে থাকলে উনি দেশের কাজ করবেন কখন? আর আপনাদের দোয়ায় শোক সইবার ক্ষমতা তার একটু বেশিই। নইলে তার সব সেক্টরেই এত মৃত্যু, কিন্তু তিনি তাতে আপনাদের মত অল্পতে কাতর হন না।

:এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। উনি যেদিকে হাত দেন, সেদিকেই হত্যার উৎসব, লাশের মিছিল। উনি শুধু গার্মেন্টস, সড়ক পরিবহন, নৌপরিবহনই সামলাচ্ছেন না, পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও। ঈদের ছুটিতে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে একশরও বেশি। লঞ্চ ডুবলেই শতাধিক সলিল সমাধির অাশঙ্কা। তাজরিনের মতো একটা গার্মেন্টসে আগুন লাগলেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় শতাধিক শ্রমিক। রানা প্লাজায় তো হাজারের বেশি চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে বিশ্বরেকর্ডই গড়েছে। মৃত্যু দেখতে দেখতে কি শাজাহান খানের আবেগ কমে গেছে, উনি নিষ্ঠুর হয়ে গেছেন? সারাজীবন দেখে এসেছি, কেউ অনশন করলে দাবি মানার আশ্বাস দিয়ে জুস খাইয়ে অনশন ভাঙ্গানো হয়। আর শাজাহান খান যখন হোটেল সোনারগাঁওয়ে মিটিং করছিলেন, তখন পুলিশ বেতন-বোনাসের ন্যায্য দাবিতে আমরণ অনশনের একাদশ দিনে তোবার শ্রমিকদর অনশন ভাঙ্গিয়েছে লাঠি, টিয়ার গ্যাস আর পিপার স্প্রে দিয়ে। আপনার কথা সত্যি হলে শাজাহান খান তো এই শ্রমিকদেরও নেতা।

:এই সবকিছুর জন্য তো আর শাজাহান খান দায়ী নন। উনি সবকিছুতে নাক গলান বলে ওনার কথা বলেন আপনারা।

: মানলাম সবকিছুর জন্য তিনি দায়ী নন। কিন্তু আর সব বাদ দিলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় তো তার অফিসিয়াল ডিউটি। এখানেও তিনি ব্যর্থ কেন?

:কে বললো ব্যর্থ ?

:এই যে বছর বছর লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে।
: ঈদের ছুটিতে অতিরিক্ত যাত্রী উঠলে তো লঞ্চ ডুববেই। মন্ত্রী তো মাওয়া ঘাটে বসে লঞ্চ পাহারা দেবেন না।
:মন্ত্রী তো ডুবে যাওয়া লঞ্চটি তুলতেও পারছেন না ?
: মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান খোলা আকাশ থেকে হারিয়ে গেল। সারা বিশ্ব মিলে খুঁজে পেল না। আর আপনি বলছেন উত্তাল পদ্মায় হারিয়ে যাওয়া এইটুকুন একটা লঞ্চ খুঁজে দিতে। কবেই তো সেটা পদ্মার ঘোলা জলে আসা পলিতে ঢাকা পড়ে গেছে। এখন চলছে স্বজনদের সান্ত্বনা অভিযান। পিনাক-৬ তোলার চেয়ে বরং খড়ের গাদায় একটা সুই ফেলে দিন। খুঁজে দেব।
:না পারলে মন্ত্রী পদত্যাগ করছেন না কেন ?
: আপনাদের এই এক সমস্যা। কিছু হলেই পদত্যাগ পদত্যাগ বলে চিৎকার জুড়ে দেন। পদত্যাগ কি গাছে ধরে! আর পদ ত্যাগ করলে উনি হাঁটবেন কী দিয়ে। পদত্যাগ তো করে ভীরু-কাপুরুষেরা, সমস্যা সামনে এলে ভয়ে পালিয়ে যায়। শাজাহান খান ভীরু নন; বীর, সাহসী। আরটিভিতে দেখেননি সরাসরি অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়াকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন তিনি। আপনারা সাংবাদিকরা টিপিক্যাল বাঙালি চরিত্রের। কারও উন্নতি সহ্য হয় না। কেউ উন্নতি করলে তাকে নামাতে তার পা মানে পদ ধরে টানাটানি করেন। আর যিনি কাজ বেশি করেন, তার সমালোচনাও বেশি। কাজ নেই তো, পদত্যাগের দাবিও নেই। মন্ত্রিসভার কত সদস্য আছে, যাদের নামই জানেন না আপনারা। শাজাহান খান অনেক কিছু করেন, তাই তার একটু আধটু ভুল হতেই পারে। আপনাদের উচিত তার মতো একজন সব্যসাচী মন্ত্রীর কর্মতৎপরতার প্রশংসা করা। সবসময় অর্ধেক গ্লাস খালি দেখলে দেশের উন্নতি হবে কিভাবে ?
: হা হা হা। সব্যসাচী লেখক জানি সৈয়দ শামসুল হক। সব্যসাচী মন্ত্রী আজ প্রথম শুনলাম। তবে আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার ভুল ভেঙেছে। আমি আর শাজাহান খানের পদত্যাগ চাই না, প্রমোশন চাই। অফিসিয়ালি নৌ পরিবহন তো সামলাচ্ছেনই, আনঅফিসিয়ালি শ্রম, বস্ত্র, বাণিজ্য, যোগাযোগ, রেলপথ সবই তার নিয়ন্ত্রণে। এখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত শাজাহান খানকে প্রমোশন দিয়ে সুপারভাইজার মন্ত্রী বানানো। সবকিছু উনি সুপারভাইজ মানে দেখভাল করবেন। কিংবা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট নামে একটা মন্ত্রণালয় বানিয়ে তাকে তার দায়িত্ব দেওয়া। যেখানেই ক্রাইসিস, সেখানেই শাজাহান খান।
:আপনার আত্মোপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ।
: আমার ভুল ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
৮ আগস্ট, ২০১৪
* আড়াই বছর আগের লেখাটি পড়ে দেখলাম, অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই আবারও শেয়ার করলাম।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.