276107

পৃথিবী ‘উল্টে’ গিয়েছিল ৮৫ বছর আগে পেশেন্ট এম-এর কাছে !

সময়টা ১৯৩৮ সাল। স্পেন তখন গৃহযুদ্ধে উত্তাল (Spanish Civil War)। সেই সময় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ২৫ বছরের তরতাজা যুবক। প্রতিপক্ষের গুলি এসে লেগেছিল সটান মাথায়! সকলকে অবাক করে দিয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন ওই যুবক। কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় যখন জ্ঞান ফিরল তখন বুঝতে পারলেন, প্রাণটুকু রক্ষা পেলেও তাঁর পুরো জগত-সংসারই উল্টে গেছে, তাও আবার আক্ষরিক অর্থেই! সেরে ওঠার পর থেকে ওই যুবক পৃথিবীর সব কিছুই ‘উল্টো’ভাবে দেখতে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ কিনা, উপরের জিনিস নীচে, এবং তলার জিনিস উপরে!

এমনটা সত্যিই ঘটেছিল স্পেনের বাসিন্দা ‘পেশেন্ট এম’-এর (Patient M) সঙ্গে। তাঁর এই নামটি দিয়েছিলেন তৎকালীন মিলিটারি হসপিটালের চিকিৎসক ২৮ বছর বয়সি জাস্তো গঞ্জালো। গঞ্জালোই গুলিবিদ্ধ ওই যুবকের চিকিৎসা করার সময় তাঁর এমন নাম দিয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পেশেন্ট এম-এর মাথা থেকে গুলি বের করেন তিনিই। রোগী প্রাণে বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর জ্ঞান ফেরার পরেই ধরা পড়ল এক অদ্ভুত নতুন সমস্যা। দেখা গেল, যখন নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে কিংবা বসে থাকছেন পেশেন্ট এম, তখন আশেপাশের সমস্ত জিনিস উল্টোভাবে দেখছেন তিনি (Inverted Vision)। শুধু উল্টোই নয়, সমস্ত জিনিস এক অদ্ভুত হালকা সবুজ আভার মধ্যে দিয়ে দেখছেন তিনি, যেন কোনও বিশেষ ‘ফিল্টার’ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে চোখে। এমনকী, একই সমস্যা হচ্ছে, শ্রবণ এবং স্পর্শজনিত অনুভূতির ক্ষেত্রেও। কোনও আওয়াজ শুনলে বা স্পর্শ অনুভব করলে সেগুলি আসলে যেখান থেকে বা যেদিক থেকে আসছিল, পেশেন্ট এম-এর মনে হত, সেগুলি ঠিক তার উল্টো দিক থেকে আসছে।

হাজার অনুসন্ধান সত্ত্বেও এই আশ্চর্য সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন চিকিৎসক গঞ্জালো। যদিও এই আশ্চর্য অসুখের কারণ নিজের মতো করে গবেষণা করে নথিবদ্ধ করেছিলেন তিনি। অসুখের সমাধান না পাওয়া গেলেও এর জন্য পেশেন্ট এম-এর কোনও বিশেষ অস্ত্রোপচার কিংবা নজরদারির প্রয়োজন পড়েনি। আর পাঁচটা মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন তিনি। সাধারণ অবস্থায় হাঁটাচলা কিংবা কথা বলার সময় এই সমস্যা হত না তাঁর। তবে নড়াচড়াহীন ভাবে এক জায়গায় বিশ্রামে থাকলেই আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী উল্টে যেত ২৫ বছরের ওই যুবকের কাছে। কোনও অক্ষর কিংবা সংখ্যা সোজা এবং উল্টো দুভাবেই দেখতে এবং পড়তে সক্ষম ছিলেন পেশেন্ট এম।

সেই ঘটনার ৮৫ বছর কেটে গেছে। সাড়ে আট দশক পর বাবার এই অদ্ভুত সমস্যার কারণ খুঁজে বের করতে উদ্যোগী হয়েছেন নিউরোলজিক্যাল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাস্তো গঞ্জালোর মেয়ে ইসাবেল গঞ্জালো। ইসাবেল নিজে মাদ্রিদের কম্পিউটার্স ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক এবং ফিজিসিস্ট। বাবার সুপ্রাচীন কেস স্টাডি ঘেঁটে পেশেন্ট এম-এর মস্তিষ্কের জটিল বিন্যাস নতুন করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখছেন তিনি। তাতেই উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সেই সময় চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মস্তিষ্ক একটি অঙ্গ হিসেবে সামগ্রিকভাবে কাজ করে। মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশের আলাদা আলাদা কার্যকারিতার ধারণা নিয়ে তখন দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। তবে জাস্তো গঞ্জালোর পরীক্ষা থেকে জানা গিয়েছিল, কোনও তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করার জন্য মানব মস্তিষ্কের একাধিক স্তর রয়েছে। বোধবুদ্ধি, কথা বলা, অনুভূতি গ্রহণ ইত্যাদি যাবতীয় কাজের জন্য সেই প্রত্যেকটি স্তরেরই আলাদা আলাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরীক্ষায় ধরা পড়েছিল, গুলিতে ওই যুবকের মস্তিষ্কে সেরিব্রাল কর্টেক্সের আবরণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই সেরিব্রাল কটেক্সই মানুষের আবেগ, চেতনা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভুতির জন্য দায়ী। গঞ্জালো দেখেছিলেন, মৌখিক নয় এমন পদ্ধতি, যেমন আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে দেখানো এবং অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম ছিলেন পেশেন্ট এম। তা থেকে তিনি এটুকু বুঝেছিলেন, তাঁর মস্তিষ্কের কিছু সাবকর্টিক্যাল স্তর অক্ষত ছিল, যে স্তরগুলি বহিঃস্থ উদ্দীপনা গ্রহণ এবং তাতে সাড়া দেয়। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের এমন কিছু অংশ গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে অংশগুলির সাহায্যে কোনও উদ্দীপনার উৎস বোঝা সম্ভব হয়।

চিকিৎসক গঞ্জালোর পরীক্ষা থেকে আরও জানা যায়, ভাষাগত প্রক্রিয়াকরণ মস্তিষ্কের একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোনও সংকেত কিংবা ভাষা বোঝা এবং বলার জন্য মস্তিষ্কের একাধিক স্তর সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এগুলির মধ্যে কোনওটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেই সমগ্র বিষয়টির উপরেই তার আঁচ এসে পড়ে।

ইসাবেলের দাবি, যুগ যুগ ধরে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বিষয়ক ধারণা তৈরি হয়ে আসছিল একক কেস স্টাডির উপর ভিত্তি করে। তবে সেই ধারণা বদলাতে সাহায্য করেছিল তাঁর বাবার একটি একক কেস স্টাডি, যেটা কিনা পেশেন্ট এম-এর ঘটনা। জগতকে উল্টো দেখার সেই ঘটনা আসলে উল্টে দিয়েছিল মানবমস্তিস্ক সম্পর্কে বহু প্রচলিত ধ্যানধারণা।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.