272083

টাকার থলে

এখন কি সন্ধে নাকি গভীর রাত! বুঝতে পারছি না। আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় শুয়ে আছি। উত্তরে হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ। সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। পূর্ণ চাঁদের সব আলো যেন উজাড় করে দিয়েছে প্রকৃতিকে। তার কিছু অংশ আছড়ে পড়েছে আমার জানালার কাঁচে। এরই মধ্যে জানালা দিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়া এসে ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। আমার শোয়ার ঘরটা এখন বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা, টাকার পেছনে ছোটা, টেনশন- এটা চাই, ওটা চাই, নাই-নাই, খাই-খাই ভাবটা মাথা থেকে নেমে গেছে ইতিমধ্যে। হার্ডডিস্ক থেকে ডিলেট হয়ে গেছে জাঙ্ক ফাইলগুলো। ব্রেনটা এখন ভীষণ কুল। আমার শরীরটাও হাল্কা হতে শুরু করেছে। শরীর মনে হচ্ছে বিছানা থেকে আলগা হয়ে গেছে। নিজেকে এতটাই হালকা লাগছে যে, চাইলেই আমি বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারব।
রুমের পরিবেশটা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। নাকে অচেনা একটা গন্ধটা পাচ্ছি। পুরো ঘরটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে। আমি বুকভরে শ্বাস টেনে নিচ্ছি আর পেট খালি করে ছাড়ছি। দারুণ একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। অনেকদিন ধরে ভালো ঘুম হয় না। আরামদায়ক টানা লম্বা ঘুম দরকার। টেনশন ফ্রি ভালো একটা ঘুম দিয়ে উঠতে পারলে শরীর মন দুটোই চাঙা হয়ে উঠবে। তাই সময় নষ্ট না করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। চোখ বন্ধ করেছি দু মিনিটও হয়নি। হঠাৎ কানে একটা শব্দ ভেসে এল। কান খাড়া করে রাখি। হ্যা স্পষ্ট শব্দ পাচ্ছি। রুমের মধ্যে কেউ একজন স্যান্ডেল পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। থেমে থেমে আসছে শব্দটি।

কিন্তু এই ঘরে তো আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। তাহলে কিসের শব্দ এটা! তবে কি আমি ভুল শুনছি। ভালো করে বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য কান পেতে আছি। মিনিট পাঁচেক ধরে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আর শুনতে পেলাম না। ভাবলাম, নিশ্চয়ই আমার শ্রুতিভ্রম হয়েছিল। পাশ ফিরে আবার চোখ বন্ধ করলাম।

কতক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিলাম মনে নেই। পদশব্দটা আবারও শুনতে পাচ্ছি। ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। রুমের মধ্যে একটা বাতাস ঢেউ খেলে যাচ্ছে। একটু আগে যে গন্ধটা আমার নাকে এসেছিল সেটা আরও তীব্রতর হয়েছে। পদশব্দ আর মিষ্টি গন্ধ একাকার হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। পুরো ব্যাপারটায় আমি বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার ভেতর কোনো ভয় বা আতঙ্ক কাজ করছে না। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে আছি। কী ঘটছে, ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছি।

দেখতে পাচ্ছি, একটা ছায়ামূর্তি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা নারিমূর্তি নাকি পুরুষমূর্তি বোঝা যাচ্ছে না। তবে ছায়ামূর্তির রূপ কিন্তু ভয়ঙ্কর না। খুব শান্ত ধীরস্থির। তার লম্বা লিকলিকে হাতে একটা কাপড়ের থলে। ছায়ামূর্তি আমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠল,

‘এই থলে ভর্তি অনেক টাকা! তোর না টাকার দরকার। টাকার টেনশনে রাতে তুই শান্তি করে ঘুমাতে পারিস না। তাই নিয়ে এসেছি। থলেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

‘থলেটা নিয়ে নে। এতে যা আছে তা দিয়ে তোর জীবন পার করে দিতে পারবি।’

আমি অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি তার থলে ভর্তি অনেকগুলো টাকার বান্ডিল। আনন্দে আমার চোখ চকচক করে উঠল। আমি মুহূর্তের মধ্যে খুশি হয়ে গেলাম। হাত বাড়ালাম থলেটা ধরার জন্য। কিন্তু কী মুশকিল, নাগাল পাচ্ছি না। আর ছায়ামূর্তিও আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে না। সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। থলেটা চোখের সামনে পেন্ডুলামের মতো দুলছে। আমি থলেটা ধরতে পারছি না দেখে সে হিহি করে হাসছে।

উপায়ন্ত না দেখে আমি খাট থেকে নামলাম। আমাকে নামতে দেখে ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়াল। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে সে সদর দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। আমিও তার পিছু নিলাম। ছায়ামূর্তি দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজাটা হাট করে খুলে গেল। সে বেরিয়ে গেল। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার সাথে বেরিয়ে পড়েছি।

টাকার থলেটা নিয়ে সে হাঁটছে আর মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। আমিও চলেছি তাকে অনুসরণ করে কিন্তু ধরতে পারছি না। সেও হাঁটছে আমিও হাঁটছি। আমি যতই হাঁটার গতি বাড়াচ্ছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ছায়ামূতি আর আমার মাঝ খানের দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে পারছি না। এভাবে রাতের আঁধারে জানা অজানা উঁচু নিচু পথ ধরে ছায়ামূর্তির পেছন পেছন হেঁটে চলেছি আমি। চোখের সামনে টাকার থলেটা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু হাতে নিতে পারছি না। সামান্য একটু দূরত্ব অথচ তা কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছি না!

পাঠকের মতামত

Comments are closed.