271489

পদ্মাসেতু যেভাবে বদলে দেবে দেশের অর্থনীতি

পদ্মার ওপারে মাদারীপুর জেলার শিবচরে হাঁস, ছাগল আর গরুর খামার ছিল সালাহউদ্দিন টিটোর। খামারটি করতে খরচ করেছিলেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। স্বপ্ন ছিল এটিকে কেন্দ্র করে একদিন বড় ফার্ম করবেন। তবে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকার বাজারে পণ্য পাঠাতে না পারায় নিয়মিত আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। ফলে ২০১৪ সালে খামারটি বেচে দিতে বাধ্য হন টিটো!
পদ্মাসেতুর নিচে দাঁড়িয়ে ডেইলি বাংলাদেশকে এই গল্প শোনাচ্ছিলেন টিটো। স্থানীয় এই সংবাদকর্মী জানান, পদ্মার ওই পাড়ে তার মতো এমন ক্ষতির সম্মুখীন ব্যবসায়ী অগণিত। সেতু হওয়ায় এসব ব্যবসায়ীরা এখন থেকে নিশ্চিতভাবেই লাভের মুখ দেখবে বলা যায়। এই অঞ্চলের মানুষ এখন পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

টিটো বলেন, ফার্ম হাউজের সেই স্বপ্নপূরণে আবার খামার চালু করবো। এখন এটি সম্ভব; কারণ বিরতিহীন যানজট আর ফেরি পার হওয়ার যন্ত্রণায় দুধ, ডিম, মাংস নষ্ট হওয়ার দিন শেষ। নিজেদের উৎপাদিত যেকোনো পণ্য এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করে আবার বাড়ি ফিরে আসতে পারবো।

টিটোর মতো দেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, শুধুমাত্র পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি অর্থনৈতিক রেনেসাঁ হয়ে যাবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে দেশের অর্থনীতিতে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্মাসেতু হয়ে যাওয়ায় পায়রা বন্দর, মোংলা বন্দর, বরিশাল, খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন কল-কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পও ঢাকার বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার পাবে। বিক্রি বেড়ে গেলে বাড়বে উৎপাদনও। বেকার বসে থাকা মানুষেরা শুরু করবে নতুন নতুন উদ্যোগ। ফলে ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

মাদারীপুরের শিবচর ও মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মাসেতুর প্রকল্পকে ঘিরে এরই মধ্যে রাস্তার দুই পাড়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন কল-কারখানা, খামার ও হোটেল ব্যবসা। সেতুর দুই পাশেই বিশাল এলাকা ঘিরে গড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চল। অনেক জায়গায় স্থানীয় ব্যবসায়ী আর উদ্যোক্তারা জমি কিনে অবকাঠামো নির্মাণ করছেন। এর সবই হচ্ছে শেষ দু’বছরে পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর। এতে করে এসব এলাকায় বেড়ে গেছে জমির দামও।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, সেতু হওয়ার পর ব্যাপক হারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এ আশায় এসব এলাকায় জমি কিনে রাখছেন অনেকে, যাতে পরে বেশি দামে বিক্রি করা যায়।

তবে পদ্মাসেতুকে ঘিরে সবচেয়ে আশার কথা হলো- এই সেতু চালু হলে মোংলা ও পায়রা বন্দর আলাদা করে গতি পাবে। এই দুই বন্দরে প্রচুর পণ্য উঠা-নামা করে যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমবে, হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। রফতানিমুখী হবে গ্রামীণ উৎপাদনও।

ডেইলি বাংলাদেশকে ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, পদ্মাসেতু হলে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি দেশের জাতীয় অর্থনীতিও দ্রুত বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন, এই আগ্রহ আরো বাড়বে। পদ্মার ওই পাড়ে জনবল সহজলভ্য, জমিও তুলনামূলক কম দাম। এটি মূলত তাদের আকৃষ্ট করছে। ফলে বড় বড় প্রযুক্তিপণ্যের কোম্পানিগুলো পণ্য উৎপাদনের জন্য এই অঞ্চলটি বেছে নেবে।

এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে খুলনার অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে অনেকে কল-কারখানা করতে গিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে। জমি-জনবল সবকিছু সহজলভ্য থাকার পরও সুবিধা করতে পারেননি, কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ভঙ্গুর। এখন গোটা অঞ্চলটি পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এই এলাকায় বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।

তিনি বলেন, পদ্মাসেতুর দুই পাড় ঘিরে কয়েকটি অর্থনৈতিক জোনের পরিকল্পনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলো করতে পারলে দ্রুত পদ্মাসেতু নির্মাণের অর্থ উঠে আসবে। ফলে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমন বাড়বে জিডিপিও।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশের উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও পদ্মাসেতু এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত থাকায় দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থাও সহজ হবে।

এদিকে বিনিয়োগ বিশ্লেষকরা বলছেন, মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলে পুরো দেশ এই সেতু থেকে সরাসরি লাভবান হবে। পদ্মাসেতুর ফলে শিল্পায়নের পাশাপাশি পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। এ অঞ্চলকে ঘিরে অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র ও সুন্দরবনে বাড়বে পর্যটকদের ভিড়।

উল্লেখ্য, প্রথমবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ ১৯৯৮ থেকে ২০০০ এই সময়ে পদ্মাসেতুর পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা প্রস্তুত করে। পরে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের সেই সেতু, যাতে ২০২২ সালের জুন মাসে যান চলাচল শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.