পশুখাদ্যই এখন মানুষের প্রিয়, আলু খাওয়ার সূচনা যেভাবে
আলু বিশ্বের জনপ্রিয় সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। নানান পুষ্টি উপকারিতায় ভরা এই আলু খাওয়া হয় বিভিন্নভাবে। বহুকাল আগে থেকেই আলু খাদ্য হিসেবে সবাই গ্রহণ করে আসছেন। তবে খুবই সাধারণ খাবার মনে হলেও আলু বদলে দিয়েছিল বিশ্ব।
তবে জানেন কি? আলু কিন্তু একসময় পশুখাদ্য ছিল। সেভাবে যত্ন নিয়ে চাষও করা হত না এই সবজিটিকে। কোনো রকমভাবে এগুলো উৎপাদন করা হয়। আর ব্যবহার হত শুধুমাত্র পশুখাদ্য হিসেবেই। মানুষের খাদ্য তালিকায় এসেছে মাত্র কয়েক শতক আগে।
অ্যান্তোয়াইন-অগাস্টিন পারমেন্টিয়ের ছিলেন একজন ফরাসী ফার্মাসিস্ট এবং খাদ্য বিজ্ঞানী। তবে আলুকে মানুষের খাদ্য হিসেবে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠা করার জন্যই মানুষ তাকে স্মরণ করে। মানুষের পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যের জন্য তার আরও অনেক অবদান আছে। যেমন, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের অধীনে স্বাস্থ্য মহাপরিদর্শক হিসেবে কর্মরত থাকার সময় তিনিই প্রথম স্মলপক্স ভ্যাক্সিন ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলেন, পাউরুটি জাতীয় খাবার নিয়ে পড়াশোনার জন্য সর্বপ্রথম স্কুলের প্রতষ্ঠিাতা তিনি। এমনকি খাবার সংরক্ষণ কিংবা রেফ্রিজারেশন নিয়েও তিনিই প্রথম গবেষণা করেছিলেন।
১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী এক যুদ্ধ হয়, যেটি ‘সেভেন ইয়ার্স ওয়ার’ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে ফরাসী সেনাবাহিনীর ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করছিলেন পারমেন্টিয়ের। যুদ্ধে তিনি প্রতিপক্ষের হাতে আটক হন। জেলখানায় তাকে খাবার হিসেবে আলু দেয়া হতো। ফরাসীরা তখন আলুকে শুধু পশুখাদ্য হিসেবেই বিবেচনা করতো।
১৬০০ শতকের শুরুর দিকে লাতিন আমেরিকা থেকে স্প্যানিশদের মাধ্যমে আলু প্রথম ইউরোপে আসে এবং ১৬৪০ সাল নাগাদ পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আলুর কারণে মানুষের শরীরে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ হয়, এই ধারণা থেকে ১৭৪৮ সালে ফরাসী পার্লামেন্ট আলু চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাশ করে। ১৭৭২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে সেই আইন বলবৎ ছিল।
যুদ্ধবন্দী থেকে মুক্ত হয়ে ১৭৬৩ সালে প্যারিসে ফিরে আসেন পারমেন্টিয়ের। ফিরেই তিনি নিউট্রিশনাল ক্যামেস্ট্রির উপর বিস্তর পড়াশোনা শুরু করেন। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ১৭৭৩ সালে এক প্রতিযোগীতায় তিনি ডিসেন্ট্রি রোগীদের জন্য পুষ্টির উৎস হিসেবে আলুর কথা প্রস্তাব করে পুরস্কার জেতেন।
তবে আলু প্রায় আট হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যান্ডিসে উৎপাদন করা হয়েছিল। যা ১৫০০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে এটি পশ্চিম এবং উত্তর দিকে, আমেরিকা এবং এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আলু অ্যান্ডিসে উৎপাদিত হলেও সারা বিশ্বে এখন এটি অবিশ্বাস্যভাবে একটি সফল খাদ্য হয়ে উঠেছে।
সেখান থেকে ১৫৩২ সালে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমেরিকা থেকে আলু বাইরের দেশে আসে। স্প্যানিশ আক্রমণের সময় হানাদাররা টমেটো, অ্যাভোকাডোস এবং কর্ন জাতীয় ফসলের সঙ্গে আলুও নিয়ে এসেছিল। সেখান থেকেই আলু চাষের চেষ্টা চলে। প্রথমে সামঞ্জস্য করা বেশ কঠিন ছিল। তবে ধীরে ধীরে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সেই জায়গা আলু চাষের উপযোগী করে তোলা হয়।
সে যাই হোক, আলু চাষ করলেও তা মানুষের খাওয়ার জন্য নয়। পারমেন্টিয়েরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৭৭২ সালে ‘প্যারিস ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন’ আলুকে মানুষের খাবার উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করে। ১৭৭৯ সালে তার প্রকাশিত বইয়ে আলু দিয়ে কীভাবে রুটি জাতীয় খাবার তৈরী করা যায়, তার রেসিপি দিয়েছিলেন। এরপর আলুকে মানুষের খাবার হিসেবে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ নেন, যার জন্য আজও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে ডিনারের আমন্ত্রণ দিয়ে তাকে আলুর নানা পদ খাইয়েছেন, রাজা-রানির কাছে উপহার হিসেবে আলুর ফুল পাঠিয়েছেন। আলু নিয়ে মানুষের মনে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য তিনি নিজের আলুক্ষেতে দিনের বেলায় সেনাপাহারার ব্যবস্থা করতেন। আবার রাতের বেলা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে সেনাপাহারা তুলে নিতেন যাতে মানুষ ক্ষেত থেকে আলু চুরি করতে পারে। এভাবে তিনি সাধারণ মানুষদের মনে আলু নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আলুকে তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে, ১৭৮৭ সালে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইস আলু চাষের জন্য প্যারিসের উপকণ্ঠে পারমেন্টিয়েরের নামে বিশাল বিশাল ৫৪ খন্ড জমি বরাদ্দ করেছিলেন!
১৭৭১ সালে পারমেন্টিয়ের একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হন। আলু নিয়ে রচিত তার গবেষণামূলক প্রবন্ধ পড়ে সব বিচারকই নিশ্চিত হন যে এটিই গম বা আটার উৎকৃষ্ট প্রতিস্থাপন। কিন্তু তারপরও ফ্রান্সে আলু ততটা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল না। ১৭৮৫ সালে ফ্রান্সে গমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং দেশের চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য পরিমাণ গম উৎপাদিত হয়। সে বছর এই আলুই ফ্রান্সকে বড় দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করে এবং আলু সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
মাত্র এক শতাব্দী আগে, এমন একটি দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল যা কয়েক বছরের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষের ফলে দেশটিতে কয়েক দশক ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অশান্তির প্রভাব পড়েছিল। অবশেষে এই দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটে আলুর মাধ্যমে। আজ যথাক্রমে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলু উত্পাদক হিসেবে পরিচিত।
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজার আদেশে আলুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা নিয়ে একটি পুস্তিকা ছাপানো হয়। ১৭৯৫ সালে আলুর নানারকম রেসিপি নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইতে আলুকে সর্বসাধারণের খাবার হিসেবে প্রমোট করা হয়। ফরাসী বিপ্লবের সময়ও মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যাপকহারে আলুর চাষ হতো। ফলে উন্নতমানের খাদ্য হিসেবে আলু প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এরপর ইউরোপ থেকে আলু ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য অংশে। লাতিন আমেরিকাতেও পশুখাদ্যের পাশাপাশি মানুষের খাদ্য হিসেবেও আলুর ব্যবহার চালু হয়। পারমেন্টিয়ের মারা যান ১৮১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। মৃত্যুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত তার সমাধির চারপাশে সবসময় আলুগাছ লাগানো থাকে।