271083

নিজ সন্তানদের নৃশংসভাবে বলি দিত বাবা-মা

চিমু সভ্যতার নাম অনেকেরই জানা। প্রায় ৫০০ বছর আগে পেরুতে ছিল তাদের বসবাস। তাদের রীতি ছিল নিজ শিশুদের বলি দেয়া। তারা শিশুদেরকে হত্যা করে উৎসর্গ করত দেবতাদের। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞ। তবে কেন? কি ছিল এর পেছনে? সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টাই করে যাচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

উত্তর পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চিমু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এর ঐতিহাসিক সময়কাল ছিল আনুমানিক ১২৫০ থেকে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দ। তারা মূলত ছিল উত্তর পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা।

চিমু সভ্যতার মানুষেরা ছিল চন্দ্র উপাসক। তারা চন্দ্রের পূজা করত। চন্দ্র, প্রকৃতি ও দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করা ছিল তাদের ধর্মাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

কৃষিকাজ ও মাছ ধরা ছিল চিমু সভ্যতার মূল ভিত্তি। কৃষিকাজের জন্য তারা পানিসেচের এক বিরাট ও জটিল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মোচে নদী থেকে পানিসেচের মাধ্যমে তারা প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে চাষের ব্যবস্থা করেছিল।

উদ্ধার করা হয় কঙ্কালগুলো

উদ্ধার করা হয় কঙ্কালগুলো

ভুট্টা ও তুলা তাদের মূল ফসল ছিল। তখনকার সময় মৃৎশিল্পের বেশ বিকাশ ঘটেছিল। তাদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলো একটু অন্য ধরনের। প্রায়ই এগুলো দেখতে কোনো না কোনো জীবজন্তুর মতো। এছাড়া ছয়তলযুক্ত কোনো বোতল বা পাত্রের উপরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তির মূর্তিও অনেকসময় দেখতে পাওয়া যায়।

চিমু মৃৎপাত্রগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কালো রঙের ব্যবহার বেশি চোখে পড়ে। মৃৎশিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করত তারা। মূলত সোনা, রুপা ও তামার মিশ্রণে তৈরি সংকর ধাতুর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় এই সভ্যতায়।

চিমু সভ্যতার রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চান চান। ধারণা করা হয়, এই শহরে এক লাখেরও বেশি মানুষ বাস করতো। সে হিসেবে এককালে বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল এই চান চান। পেরুর এই শহরটি পুরোটাই মাটির তৈরি।

শহরটিতে দেখা যেত ইটের তৈরি বড় বড় প্রাসাদ। ১৪৭০ সালে তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানের পতন ঘটে। পতনের পর ইনকা সম্রাট তুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের এলাকা দখল করে। দখলের পর তাকে ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে।

চিমু সভ্যতারা এখানেই বাস করত

চিমু সভ্যতারা এখানেই বাস করত

প্রায় ৫০ বছর আগে স্পেনীয়দের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। ঘটা এই যুদ্ধেই স্বাধীন রাজ্য হিসেবে চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে। চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটলেও তারা এ পৃথিবীতে আজীবনের জন্য রেখে যায় এক নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস।

এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণারত একদল প্রত্নতাত্ত্বিক খুঁজে পেয়েছেন প্রায় ১৪০টি শিশুর দেহাবশেষ। দেহগুলো মূলত তখনকার সেই বলি দেয়া শিশুদের দেহাবশেষ। চিমু সভ্যতা তাদের শতাধিক শিশু এভাবেই উৎসর্গ করেছিলো।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অর্থায়নে পরিচালিত এই আবিষ্কার প্রক্রিয়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির গ্যাব্রিয়েল প্রিয়েতোর নেতৃত্বাধীন একটি দলের অভিযানের মাধ্যমে নারকীয় এই শিশু হত্যাযজ্ঞ সকলের নজরে আসে।

২০১১ সালে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো একটি মন্দিরের কাছ থেকে ৪২টি শিশু ও ৭৬টি লামার দেহাবশেষ উদ্ধার করে। আর এই উদ্ধারের পরই এই অভিযান শুরু করে দলটি। চূড়ান্ত হিসেব অনুযায়ী, সেসময় বলি দেয়া ১৪০ জন শিশুর কংকাল উদ্ধার করা হয়। যাদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছর। তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ছিল ৮ থেকে ১২ বছর। অনেক শিশুর হাড় কেটে ফেলার চিহ্ন দেখা যায়।

উদ্ধার করা শিশুর কঙ্কাল

উদ্ধার করা শিশুর কঙ্কাল

বুকের পাঁজর ও হাড় দেখেই শনাক্ত করা হয় যে, এগুলো শিশুদের দেহাবশেষ। অনেক কঙ্কালের পাঁজর নষ্ট হয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, এই শিশুদের হৃৎপিণ্ড খুলে নেয়া হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছিল ২৬৯ জন শিশুকে।

শিশুদের পাশাপাশি লামা নামক এক ধরনের পশুর ও প্রায় ২০০টি কঙ্কাল উদ্ধার করেছে অভিযানকারী দল। এই থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, শিশুদের সঙ্গে লামা নামক পশুকেও বলি দেয়া হয়। লামা মূলত উট জাতীয় এক ধরনের পশু। যেগুলো এই এলাকার শিশুদের খুবই প্রিয়। আর এই লামাগুলোর বয়স ছিল ১৮ মাসেরও কম।

সত্যিই এই ঘটনা জানার পর একজন মানুষের মনে প্রথম প্রশ্ন এটাই আসবে যে, শিশুগুলোর কি অপরাধ ছিল? নানা সময়ে তারা নানা কিছু উৎসর্গ করতো চন্দ্র ও প্রকৃতিকে খুশি করতে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, এই এলাকাকে অতিবৃষ্টি অথবা বন্যা থেকে রক্ষার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিলো এই শিশুদের।

শিশুদের কংকালের সঙ্গে পাওয়া বিভিন্ন কাপড়ের কার্বন পরীক্ষা করে দেখা যায়, ঘটনাটি ১৪০০ থেকে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঘটেছে। পৃথিবীর দীর্ঘ মানব ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে নরবলির এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। একসময় প্রকৃতি কিংবা দেব-দেবীকে খুশি করার জন্য নরবলির প্রচলন ছিল অনেক সভ্যতায়।

নরবলি দেয়া শিশুদের মাথার খুলি

নরবলি দেয়া শিশুদের মাথার খুলি

তবে এমন নারকীয় শিশুবলির দৃষ্টান্ত আর কোথাও পাওয়া যায় না। বর্তমানে সবচেয়ে বড় শিশুবলির ঘটনা হিসেবে দেখা হত মেক্সিকো সিটির টেম্পল মায়োরে ৪২ জন শিশুকে উৎসর্গ করবার সেই নৃশংস ঘটনাকে। তবে চিমু সভ্যতার এই শিশুবলি সকল নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গেছে।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক গবেষণা করেও কোনো লিখিত দলিল কিংবা দস্তাবেজ খুঁজে পাননি। তবে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল থেকে এটা জানা যায় যে, ইনকা সভ্যতায় শত শত শিশুবলি দেয়া হতো কোনো রাজার মৃত্যুর পর।

তবে চিমুরা ঠিক কি কারণে শিশুবলি দিত তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল পাওয়া যায় নি। তবে যেখান থেকে শিশুদের কংকাল উদ্ধার করা হয়। সেখানে শুকনো কাদামাটির স্তুপ পাওয়া যায়। শুকনো কাদামাটি এখানে এককালে অতিবৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়।

তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, কোনো এককালে এখানে অতিবৃষ্টির কারণে কিংবা এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এবং ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে চিমু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছিল। আর তাই এই শিশুদের এমন নৃশংসভাবে বলি দেয়া হয়।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.