270878

এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর হাত ধরেই আসে বাংলার প্রথম ‘বৈদ্যুতিক পাখা’

শরীরের নাম মহাশয় যাহা সহাবে তাহাই সয়- এই কথাটি কিন্তু বাস্তব। আজ মানুষের জীবন ও স্বাচ্ছন্দ্য এমন স্তরে পৌঁছেছে। তার জন্য অবশ্যই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ভূমিকা কম নয়।
এজন্য বৈদ্যুতিক পাখা, এয়ার কন্ডিশন, কুলার ইত্যাদি ঘর ঠান্ডা রাখার উপায় বের হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন এসব কিছুই ছিল না। তার মানে এই নয়, যে তখন গরম ছিল না।

তখন সরকারি অফিসে নিয়োগ হতো পাঙ্খা পুলার। আর এই পাঙ্খা পুলার সরকারি অফিসে সাহেবদের মাথার উপর এক বিশাল কাপড়ের পাখা থাকতো। পাখা সঙ্গে দড়ি লাগিয়ে টানতো বাইরে থেকে পাঙ্খা পুলার। তবে তাতে তেমন জোরে বাতাস হত না, তা বৈদ্যুতিক পাখার থেকে খুবই দুর্বল ছিল।

তাই আসে বৈদ্যুতিক পাখা। কাজ হারায় ওই কর্মীর দল। এবার আসি কলকাতার প্রথম দেশীয় বৈদ্যুতিক পাখা কোম্পানির কথায়। যা বিদেশি কোম্পানিগুলোর তৎকালীন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেটিও নির্মাণ করেছিলেন এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। কে তিনি ? আর কোথায় এই কোম্পানি? আজ জানাবো সে সম্পর্কে-

এককথায় বলা চলে নতুন হাওয়া তৈরির কারিগর। নাম তার ক্ষীরোদ বিহারী চক্রবর্তী। প্রথম এই শহরে হাওয়ার জন্যই পাঙ্খাকুলি নিয়োগ হতো। তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে অচল হয়ে পড়ে। আর সেই সময় দেশের মানুষকে তাদের আয়ত্ত্বের মধ্যেই ঠান্ডা হওয়ার স্বাদ আস্বাদন করিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষীরোদ বিহারী।

হাতে টেনে নয় সুইচ দিলেই বিদ্যুতে সেই হাওয়া চলত শনশোনিয়ে। তাতে জন্ম হয়েছিল ক্লাইড কোম্পানি। বাঙালির তৈরি কলকাতার প্রথম বৈদ্যুতিক পাখার কোম্পানি। জায়গাটি কিন্তু বেশ পরিচিত। কলকাতার এলিট সিনেমা হলের পাশে হিন্দুস্থান ইন্সিওরেন্স কোম্পানির বিশাল অফিস। আর এই সিনেমা হলের এক পাশে ছিল ক্লাইড এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।

১৯১৯ সালে এই ক্লাইড এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড তৈরি ফ্যান প্রথম হাওয়া এনেছিল কলকাতায়। ক্ষীরোদবিহারীকে এই কোম্পানি গড়তে সাহায্য করেছিলেন ময়মনসিংহের মহারাজা রাজেন্দ্রকিশোর, পাইকপাড়ার কুমার অরুণ সিংহ প্রমুখ ধনী ব্যক্তিরা। ক্ষীরোদবিহারী ছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী।

তার বাড়ি পূর্ব বাংলার নারায়ণগঞ্জের বন্দর গ্রামে। জলপাইগুড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ক্ষীরোদ বিহারী। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সময় তার সেই কার্যকলাপ আরো দৃঢ় হয়।

পুলিশ ধাওয়া করা শুরু করে। অগত্যা দেশ ছেড়ে পালান ক্ষীরোদবিহারী। একটি কার্গো জাহাজে পে-মাস্টারের চাকরি নেন তিনি। সেখানে ইলেকট্রিকের কারিগরদের থেকেই ওয়ারিং, ফ্যান মেরামতি ইত্যাদি কাজ শিখে অর্থ সঞ্চয় করেন। এরপর কলকাতায় ফিরে ১৯১৮ সালে ইলেকট্রিক ফ্যানের কারখানা নির্মাণ করেন।

ক্লাইড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি অন্যান্য বিদেশি কোম্পানিকে বেশ বিপাকে ফেলে দেয়। চাহিদা ও উৎপাদনের বৃদ্ধির সঙ্গে বকুল বাগান রোডে তৈরি হয় অ্যাপ্রেনটিস ট্রেনিং স্কুল। ছেলেরা তো ট্রেনিং নিতই পরবর্তীতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সূক্ষ্মকাজ শিখতো।

বাঙালি যুবকের তৈরি স্বদেশি যুগের হাওয়ায় তখন দেশবাসী মজে। তবে পরপর যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ছাপ ফেলে ক্লাইড এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে। এরপর দেনার দায়ে বিক্রি করে দিতে হয় কোম্পানিটিকে। তবে সংগ্রামী মানসিকতা এতো সহজে ভাঙার নয়।

তাই ১৯৩২ সালে তিনি হিন্দুস্তান পার্কের একটি জমিতে তৈরি করেন নিজস্ব ফ্যান তৈরির কারখানা ক্যালকাটা ফ্যান। অনেক ঝড়ঝাপটার পরেও ক্যালকাটা ফ্যান চলেছিল দেড় বছর। চিরকাল কোনোকিছুই স্থায়ী হয় না। আয়ু ফুরায়। তবে ক্ষীরোদবিহারী নিরলস প্রচেষ্টা সত্যিই আশ্চর্য করে দেয়।

ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় ফ্যান কোম্পানির বিশাল বাজারে যেভাবে সে টিকে ছিল তা শেখার মতোই। বারবার তিনি সব হারিয়েছেন। আর বারবারই উঠে এসেছেন নতুন কিছু করার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে। ইংরেজদের দূরে ঠেলে বাংলাকে নতুন আলো দেখিয়েছিলেন তিনি। তা শুধু ব্যক্তিগত তাগিদে নয়। দেশ গড়ার প্রবল প্রেরণায়।

বাঙালি ব্যবসায়ীদের ইতিহাস নিশ্চয়ই লেখা হবে একদিন। সেদিন ক্ষীরোদ বিহারীর অবদান নিশ্চিত অনেক বড় করে লেখা থাকবে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.