270771

হ্যালোইন: ভূতেদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ

সারাবছর প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস থাকেই। এর মধ্যে থাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক। জাতীয় দিবসগুলো যার যার দেশে পালিত হলেও আন্তর্জাতিক দিবসগুলো পালন করা হয় সারাবিশ্বেই। বছর এভাবেই শেষ হতে চলল। তবে অক্টোবর মাসের শেষের দিনটি পশ্চিমাদের জন্য এক আনন্দের দিন।

এই দিনটি তারা উতসর্গ করে মৃত আত্মাদেরকে। অবাক লাগছে নিশ্চয়। একটু অবাক হওয়ারই কথা। এটি মূলত খ্রিষ্টানদের একটি উৎসব। পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘটা করে পালন করা হয় দিনটি। তবে আমাদের দেশেও কিছু কিছু জায়গাতে এই দিনটি পালন করতে দেখা যায়। অনেকেই এই হ্যালোইন ডে বা হ্যালোইন দিবসের কথা জানেন। তবে অনেকেই হয়তো এখনো জানেন না এই দিবসটির পেছনের গল্প। তাদের জন্যই আজকের লেখা।

চলুন জেনে নেয়া যাক হ্যালোইন ডে’ র আদ্যোপান্ত- 

মিষ্টি কুমড়ার ভেতরে এভাবেই বাতি জ্বালানো হয়

মিষ্টি কুমড়ার ভেতরে এভাবেই বাতি জ্বালানো হয়

হ্যালোইন বা হ্যালোউইন আসলে “অল হ্যালোজ’ ইভ”-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে পালিত হয় ৩১ অক্টোবর তারিখে, অল হ্যালোজ’ ডে। এই দিনটি অনেক দেশে সরকারি ছুটিতেও অন্তর্ভূক্ত। মূলত খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকেন।

হ্যালোইন’ বা ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি এসেছে স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ’ ইভ থেকে। হ্যালোইন শব্দের উৎপত্তি ১৭৪৫ সালের দিকে। ‘হ্যালোউইন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘শোধিত সন্ধ্যা বা পবিত্র সন্ধ্যা’। এই হ্যালোউইন উৎসব নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় মাতামাতির শেষ নেই।

বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলোতে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে এই দিবস পালন করা হয়

বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলোতে নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে এই দিবস পালন করা হয়

রাতটি উদযাপন করতে সেখানে মাসজুড়ে চলে প্রস্তুতি। দিনটিকে ঘিরে পুরো অক্টোবর মাসব্যাপী চলে আয়োজনের ঘনঘটা। কুমড়োর লণ্ঠন তৈরি, বাড়িঘর-রাজপথ সাজানো ও চকলেট-পেস্ট্রি তৈরিতে ব্যস্ত থাকে আয়োজকরা।

বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকগুলো দেশে হ্যালোইন পালিত হয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, পুয়ের্তো রিকো, এবং যুক্তরাজ্য। এছাড়া এশিয়ার জাপানে এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও হ্যালোইন পালিত হয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে আমেরিকায় জাতীয়ভাবে হ্যালোইন ডে পালিত হতে থাকে। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের ভেতর পুরো আমেরিকায় হ্যালোইন ডে’র আনুষ্ঠানিকতা বাড়তে থাকে। পরে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

এক লোকাচারবাদী লেখকের মতে, পুরো আয়ারল্যান্ডে লোকাচার ও বিশ্বাসের সঙ্গে খ্রিষ্টানধর্মপূর্ব আইরিশদের লোকাচার ও বিশ্বের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর সমঝোতা ছিল। ঐতিহাসিক নিকোলাস রজার্স হ্যালোইনের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে রোমানদের প্রাচুর্যময় ফলের দেবী পোমানার সম্মানে ভোজের সঙ্গে হ্যালোইন এর সম্পৃক্ততা পান। এ প্রসঙ্গে আরও নানা ধরনের পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। তবে আধুনিক হ্যালোইন লোকাচারকে খ্রিষ্টীয় ধর্ম মতবাদের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। ৩১ অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের ১ ও ২ তারিখে ইউরোপ-আমেরিকার অধিকাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হ্যালোইন উৎসব পালন করে।

ভূত সেজে সবাই এদিন ঘুরে বেড়ায়

ভূত সেজে সবাই এদিন ঘুরে বেড়ায়

আচ্ছা চলুন এর উৎপত্তির সময়টাতে ফিরে যাওয়া যাক। আনুমানিক দুই হাজার বছর আগে আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাসকারী কেল্টিক জাতি নভেম্বরের প্রথম দিনটি তাদের নববর্ষ হিসাবে পালন হতো। এই দিনটিকে তারা গ্রীষ্মের শেষ ও অন্ধকার বা শীতের শুরু এবং অক্টোবরের শেষ দিনটিকে সবচেয়ে খারাপ রাত বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করতেন অক্টোবরের শেষ রাতে সমস্ত অতৃপ্ত আত্মা ফিরে আসে।

ওই দিন উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইন ডাইনি নাকি উড়ে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। কখনও বা সবুজ খরখরে দেহের ডাইনি বুড়ি কড়া নাড়ে কোনো বাড়ির দরজায়। নিশ্চয় টম এন্ড জেরি কার্টুনের সিরিজের কথা ভাবছেন। টম আর জেরিকে সবুজ গায়ের রঙের যে এক হাড়জীর্ণ ডাইনি বুড়ি ঝাড়ুতে করে উড়ে বেড়ায় আর জ্বালাতন করে। হ্যাঁ, এই কার্টুন চরিত্রটি এই ধারণা থেকেই তৈরি করা হয়েছিল।

এদের সঙ্গে মানুষের দেখা হলে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে বলে। তাই এই রাতে তারা বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে কাটাতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেল্টিক জাতির এই উৎসবই এখন ‘হ্যালোইন’ উৎসব’-এর রূপ পেয়েছে। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দুটো ব্যাপার জড়িত। একটা হল ‘ট্রিক অর ট্রিট’ আর আরেকটি হল জ্যাকের বাতি। কুমড়োর বাতিও জ্বালিয়ে রাখতেন এজন্য।

হ্যালোইন উৎসবের বয়স প্রায় দুইশ বছর

হ্যালোইন উৎসবের বয়স প্রায় দুইশ বছর

বিভিন্ন লোককাহিনীতে বলা হয়েছে, এদিন সব মৃত ব্যক্তিরা ৩১শে অক্টোবর রাত্রিতে জীবিতদের বিশ্বে আসে আগামী বছরের নতুন দেহ নেয়ার জন্য। এজন্য গ্রামবাসীরা এই খারাপ আত্মাদের থেকে বাঁচার জন্য ব্যবস্থা নেয়। এই প্রথাটি ছিল পবিত্র বেদি আগুন বন্ধ করা এবং নতুন আগুন জ্বালানো হতো পরবর্তী প্রভাতে।

আইরিশ, যুক্তরাজ্যবাসী কেল্টদিগের পুরোহিতরা তারা মিলিত হতো একটি অন্ধকার ওক বনের ছোট পাহাড়ে নতুন আগুন জ্বালানোর জন্য এবং বীজ ও প্রাণী উৎসর্গ করতো। আগু্নের চারিদিকে নাচতো এবং গাইতো প্রভাত পর্যন্ত, পথ অনুমোদন করতো সৌর বছর এবং আঁধার ঋতুর মধ্যে। যখন প্রভাত হয়, আইরিশ, যুক্তরাজ্যবাসী কেল্টদিগের পুরোহিতরা প্রতি পরিবার থেকে জ্বালানো অগ্নির কয়লা পরিধান করতো।

ছোট ছোট বাচ্চারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে দরজায় কড়া নেড়ে বলে ‘ট্রিক অর ট্রিট’। তখন সেই বাড়ির থেকে বাচ্চাদের ঝুলিতে কিছু ক্যান্ডি বা খাবার-দাবার দিয়ে দেয়া হয়। হ্যালোউইন ঘটা করে পালন করে ইউনিসেফও। তাদের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের অনেকেই এদিন ভূত সেজে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ খেলার ছলে সংগ্রহ করে তহবিল। আর সে তহবিল খরচ হয় অসহায় শিশুদের জন্য।

বর্তমানে আমেরিকায় হ্যালোউইন ডে’র বাণিজ্যিক গুরুত্বও রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হ্যালোউইন উপলক্ষে পোশাক-সহ অন্যান্য ফ্যাশনে নানা ধরনের পরিবর্তন প্রতি বছরই হয়ে থাকে। বিশেষত সাজসজ্জার সরঞ্জাম, ক্যান্ডি-সহ নানা ধরনের সামগ্রী প্রস্তুতকারীদের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য আমেরিকার ব্যবসায়ীদের কাছে হ্যালোউইন আশীর্বাদের উৎসব। দেশটি প্রতিবছর হ্যালোউইন ডে উৎসবে খরচ করে প্রায় ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

হ্যালোইন উৎসব

হ্যালোইন উৎসব

গোস্টের বাংলা অর্থ হচ্ছে ভূত। আর এই গোস্ট শব্দটি প্রাচীন ইংরেজির গাস্ট থেকে উদ্ধৃত। ল্যাটিনে ‘স্পিরিটাস’ শব্দটির অর্থ হলো শ্বাস বা জোরে বাতাস ত্যাগ করা। এমন নানান ব্যাখ্যা রয়েছে। সেই আদিকাল থেকেই ব্যাখ্যাগুলো রয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। প্রাচ্যের অনেক ধর্মে পর্যন্ত ভূতের উল্লেখ আছে। যেমন হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ-এ ভূতের কথা বলা আছে। হিব্রু তাওরাত ও বাইবেলেও ভূতের উল্লেখ আছে।

সেই উনিশ শতকে ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ বইতে লেখক চার্লস ডিকেন্স ভূতের কথা তুলে ধরেছিলেন। ভূতের কাহিনী আরও অসংখ্য স্থানেই লিপিবদ্ধ আছে। সংস্কৃতিতে ‘ভূত’ শব্দের অর্থ অতীত। এই বিশাল অতীতকালের ব্যাপ্তির মাঝে কখন কীভাবে ভূতের উদ্ভব হয়েছে সেটা জানা মুশকিল। তবে ভূতের ধারণাটি তো একদিনে হয়নি, যুগে যুগে এটা প্রতিষ্ঠিত।

তবে আধুনিক বিজ্ঞান ভূত বিষয়টিকে স্বীকার করে না। আবার এমন হাজারো ঘটনা আছে যেগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনি। আর তখনই দ্বিধা বাড়ে তাহলে কী সত্যি ভূত বলে কিছু আছে কি না। পৃথিবীর নানা প্রান্তের উপকথা, গল্প এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ভূতের উল্লেখ।

বলা হয়েছে ভূত হলো আত্মা বা স্পিরিট। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার অদৃশ্য উপস্থিতি। যদিও তার বিবরণ সর্বত্র এক নয়। কোথাও বায়বীয়, কোথাও পানির মতো, কোথাও ছায়া আবার কোথাও তারা পশুপাখির অবয়বে বিরাজমান। ভূত নামের এই অদৃশ্য অলৌকিক এবং কাল্পনিক অবয়বটির প্রতি কমবেশি সবারই অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.