270767

ট্রাক ড্রাইভার থেকে যেভাবে হলেন পর্দার জেমস বন্ড

দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসিক, বুদ্ধিমান গুপ্তচর জেমস বন্ড। জেমস বন্ড ১৯৪১ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ রানির অধীনে কর্মরত একজন সরকারি চাকুরীজীবি। কালো স্যুট, সুদর্শন, সাহসী এক ব্রিটিশ স্পাই; উদ্দাম যৌবন, নারীসঙ্গ। আর তার সঙ্গে একের পর এক অভিযান। ‘০০৭’-এর এমন রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।

আচ্ছা বলুন তো ডেভিড নিভেন, রজার মুর, ড্যানিয়েল ক্রেগ, শন কোনারি, পিয়ার্স ব্রসনান- এই অভিনেতাদের মধ্যে মিল কোথায়? প্রশ্নটার উত্তর দিতে বেশি দেরি করবেন না সিনেপ্রেমীরা। হ্যাঁ, জেমস বন্ড। তবে জেমস বন্ডের বাস্তব অস্তিত্ব সন্ধান করতে গিয়ে নানা মানুষের নাম সামনে এসেছে। আর সেই নামের মধ্যেই উজ্জ্বলতম হলেন ডাসকো পোপভ। পর্দার বন্ডের মতো ইনিও ছিলেন একজন স্পাই। আরও ভালো করে বললে ট্রিপল স্পাই।

অস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার জয় করেছেন তিনি

অস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার জয় করেছেন তিনি

একসঙ্গে তিনটে দেশের গুপ্তচরবৃত্তি করতেন তিনি। মূলত কাজ করতেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫ এবং এমআই৬-এর হয়ে। আর জার্মান নাৎসিদের হয়েও কাজ করেছেন; তবে সেখানে পোপভের কাজটি ছিল ভুল তথ্য সরবরাহ করা আর ভেতরের খবর নিয়ে আসা। এই সার্বিয়ান গোয়েন্দাই ছিলেন ‘জেমস বন্ড’ তৈরির অন্যতম প্রধান চালচিত্র। পোপভের জীবনযাত্রা, নারীসঙ্গ এবং গোয়েন্দার চরিত্রটিকেই বইয়ে এবং পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ইয়ান ফ্লেমিং।

শন কনেরি

শন কনেরি

তবে আজ বাস্তবের জেমস বন্ড নন। বলব পর্দার জেমস বন্ড খ্যাত শন কনেরির কথা। ঝাঁ চকচকে গাড়ি। শত্রুকে ঘায়েল করার গ্যাজেট। আর অবশ্যই হৃদয় তোলপাড় করা স্বল্পবসনারা। জেমস বন্ডের চরিত্রে যেমন শন কানারিকে অনেকে ভুলতে পারেননি। জেমস বন্ডের চরিত্রে স্কটিশ অভিনেতা শন কানারিকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৬২ সালের ফিল্ম ‘ডক্টর নো’-তে। তাতে বন্ডগার্ল ছিলেন উরসুলা আন্দ্রেস। হানি রাইডারের চরিত্রে সুইস অভিনেত্রীর চোখের ইশারায় পর্দার বাইরেও অনেকে কেঁপে উঠেছিলেন। উরসুলাকেও খ্যাতি এনে দিয়েছিল ‘ডক্টর নো’।

নারীরা তার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হতেন

নারীরা তার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হতেন

পর্দার শন কনেরির জীবনে অন্য আর দশজন মানুষের মতোই উত্থান পতন ছিল। ছিলেন ট্রাক ড্রাইভার, বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করেছেন একসময়। সেই ছেলেটিই আজ জেমস বন্ড খ্যাত জনপ্রিয় অভিনেতা।

অল্প বয়সে স্কটল্যান্ডের রুক্ষ রাস্তার বুক পেরিয়ে বাড়ি বাড়ি দুধ দিয়ে আসত যে কিশোর, তার রুপোলি পর্দার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শো-ম্যান হিসাবে পদার্পণ করার যাত্রাটাও অনেকটা সেরকমই! কিছুটা বড় হতেই অর্থ রোজগারের জন্য ব্রিটিশ নেভিতে যোগদান। কিন্তু শারীরিক সমস্যার জন্য বেশিদিন কাজ করা হল না। অগত্যা এডিনবরায় ফিরে আসা।

পর্দায় চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতেন তিনি

পর্দায় চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যেতেন তিনি

জীবনধারণের জন্য করতে শুরু করলেন বিভিন্ন কাজ। কখনও ট্রাক ড্রাইভার তো কখনও লাইফগার্ড। কখনও শ্রমিক তো আবার কখনও কফিন পালিশার। মিঃ ইউনিভার্স বডিবিল্ডিং কনটেস্টেও করে ফেললেন অংশগ্রহণ। এর সুবাদেই পার্ট টাইম আর্টিস্ট মডেল হিসেবে এডিনবরা কলেজ অফ আর্টে পাওয়া গেল একটা কাজ।

ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করল এখান থেকেই। কয়েকবছর টেলিভিশনে আর সিনেমায় বেশ কিছু সাপোর্টিং রোলে অভিনয় করার পর তার টেবিলে এসে পড়ল ‘ডক্টর নো’-এর স্ক্রিপ্ট। ইয়ান ফ্লেমিং তাকে দেখার পর যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তার লিখিত এমন অতিমানবীয় ম্যানারিজমের মানুষটাকে এমন মাটিতে লেপ্টে বড় হওয়া একটা ছেলে  বিন্দুমাত্র ফুটিয়ে তুলতে পারবে কি না।

এক বান্ধবীর সঙ্গে শন কনেরি

এক বান্ধবীর সঙ্গে শন কনেরি

ফ্লেমিং-এর বন্ডকে নিজের করে নিয়েছিলেন শন কনেরি। তাকানো, কথা বলা, মুচকি হেসে সিগারেট ধরানো থেকে এক মুহূর্তে নারীদের নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে নেয়া। প্রতিটা অভিব্যক্তিতে, প্রতিটা সিনে শন ছিলেন অনবদ্য। রুপালি পর্দার প্রথম বন্ড হিসাবে সেই চরিত্রের আবেদনকে যে জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন শন, তা অতুলনীয়। যেকোনো জিনিস প্রথম করতে এগিয়ে আসার দুটো দিক থাকে।

এক, সাফল্য এলে আপনি চিরকালের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে যাবেন। আর দুই আপনি অসফল হলে আপনার দেখানো পথেই আপনার করা ভুল শুধরে নিয়ে অন্য কেউ হয়ে উঠবে নায়ক। শন সেই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। বলা ভালো নিতে পেরেছিলেন। তার বেড়ে ওঠা, জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি এই চরিত্রের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল অমর হয়ে যাওয়ার রসদ।

শন কনেরি

শন কনেরি

শুধুমাত্র বন্ড হিসাবেই নয়, অন্যান্য চরিত্রে অভিনেতা হিসাবে নিজের অসামান্য অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন শন। এনট্র্যাাপমেন্টে যৌন টানাপোড়েন ফুটিয়ে তোলা থেকে দ্যা আনটাচেবেলসে রুক্ষ, টাফ আইরিশ পুলিশ সবেতেই সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। ইন্ডিয়ান জোনসে, তার পিতার চরিত্রেও ছিলেন অদ্বিতীয়। বন্ডকে সরিয়ে নিলেও অভিনেতা শন আলাদাভাবেই থেকে যাবেন সমস্ত সিনেপ্রেমীদের বুকে!

এই অভিনেতার জন্ম স্কটল্যান্ড, এডিনবরা ফাউন্টেইন ব্রিজ এলাকায় ১৯৩০ সালের ২৫ অগাস্ট। পুরো নাম টমাস শন কনেরি। এই নাম রাখা হয় দাদার নামানুসারে। তার মা ইফেমিয়া ম্যাকবেইন ম্যাকলেইন সাফসুতরোর কাজ করতেন আর বাবা জোসেফ কনেরি ছিলেন কারখানার শ্রমিক ও ট্রাক ড্রাইভার। গত ৩১ অক্টোবর ২০২০ সালে অস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার জয়ী ও জেমস বন্ড খ্যাত অভিনেতা শন কনেরি মারা যান।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.