270366

আয়ারল্যান্ডে সাপ না থাকার রহস্য

ইংল্যান্ডের পাশে অবস্থিত প্রায় ৮৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ছোট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র আয়ারল্যান্ড। শুনতে অদ্ভুত মনে হতে পারে, তবে পুরো আয়ারল্যান্ডে কোনো সাপ নেই।

ব্যক্তিগতভাবে কিছু শৌখিন ব্যক্তির সংগ্রহে বা চিড়িয়াখানায় অবশ্যই অল্প কিছু সাপ আছে, কিন্তু পুরো আয়ারল্যান্ডের বনে-জঙ্গলে কোথাও কোনো সাপ নেই।

আইরিশ রূপকথা অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে সাপ না থাকার কারণ হচ্ছে, সেইন্ট প্যাট্রিক নামের এক ধর্মপ্রচারক মন্ত্রের জোরে সব সাপকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি নাকি সাপের হাত থেকে আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করেছিলেন।

বাস্তবে এই ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, সেইন্ট প্যাট্রিকের পক্ষে সাপ নির্বাসিত করা সম্ভবই ছিল না। কারণ আয়ারল্যান্ডে কোনোকালেই সাপ ছিল না।

আয়ারল্যান্ড

আয়ারল্যান্ড

ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক নাইজেল মোনাগান জানান, আয়ারল্যান্ডে কখনোই কোনো সাপের ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ অঞ্চলে কোনো সাপ ছিল না।

বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি সাপ আছে। তবে আয়ারল্যান্ডে কেন সাপ নেই? এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, আয়ারল্যান্ড একটি দ্বীপ।

কাছাকাছি স্থলভূমির সঙ্গে আইরিশ সমুদ্রের উপর দিয়ে এর দূরত্ব সর্বনিম্ন ৭০ কিলোমিটার। কোনো সাপের পক্ষে এতো দূরের পথ সাঁতরে পাড়ি দেয়া সম্ভব না।

সামুদ্রিক সাপের কথা অবশ্য ভিন্ন, তারা দীর্ঘসময় পানিতে থাকতে পারে এবং দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে পারে। তবে সামুদ্রিক সাপের বসবাস উষ্ণ জলবায়ুর অঞ্চলগুলোতে। আয়ারল্যান্ডের বরফ-শীতল আটলান্টিক মহাসাগর তাদের বসবাসের জন্য উপযোগী না।

এ হিসেবে অবশ্য এই এলাকার কোনো দ্বীপেই সাপ থাকার কথা ছিল না। তবে আয়ারল্যান্ডের নিকটবর্তী ইংল্যান্ডেই প্রচুর সাপ এবং ইংল্যান্ডও একটি দ্বীপ-রাষ্ট্র। প্রশ্ন উঠতে পারে, পাশাপাশি দুটো দ্বীপের মধ্যে একটিতে সাপ আছে, অন্যটিতে নেই কেন?

ধর্মপ্রচার্কই নাকি সাত তাড়িয়েছিলেন

ধর্মপ্রচার্কই নাকি সাত তাড়িয়েছিলেন

এর উত্তর নিহিত আছে আয়ারল্যান্ডের সৃষ্টির ইতিহাসে। এক সময় আয়ারল্যান্ড বা ইংল্যান্ড কোনো দেশেই কোনো সাপ ছিল না।

বরফ যুগে এই দ্বীপগুলো সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর বসবাসের জন্য উপযোগী ছিল না। কারণ শীতল রক্ত বিশিষ্ট সরীসৃপ শ্রেণীর প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য আশেপাশের পরিবেশ থেকে তাপ শোষণ করতে হয়।

আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগের কথা। তখন সর্বশেষ বরফ যুগের অবসান ঘটে। আর তখনই বরফ গলতে শুরু করে। প্রথম দিকে আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড-ইউরোপ যাতায়াতের স্থলপথ বিদ্যমান ছিল।

বরফের আচ্ছাদনে তৈরি এসব সরু সেতুবন্ধনের মতো স্থলভাগের উপর দিয়েই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করা যেত।

তবে পৃথিবী যত উষ্ণ হতে থাকে, এসব বরফের সংযোগ পথ ততোই গলতে থাকে। একসময় সমুদ্রে বিলীন হয়ে আয়ারল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে।

আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সংযোগ পথটি সমুদ্রের বুকে বিলীন হয় আজ থেকে প্রায় সাড়ে আট হাজার বছর আগে। ততদিনে বাদামি ভালুক, বন্য শূকর, এবং বন বিড়ালসহ বেশ কিছু প্রাণী আয়ারল্যান্ডে স্থান করে নিলেও সরীসৃপরা তখনো সেখানে পৌঁছাতে পারেনি।

সেই তুলনায় ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইউরোপের সংযোগ পথটি আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইউরোপের সংযোগ পথ সমুদ্রে ডুবে গিয়ে ইংল্যান্ডকে দ্বীপে পরিণত করে।

ততদিনে অন্যান্য অনেক প্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে সাপের অন্তত তিনটি প্রজাতি ইংল্যান্ডের মাটিতে নিজেদের আবাসভূমি তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রাণী ইউরোপ থেকে আয়ারল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য অন্তত দুই বছর বেশি সময় পেয়েছিল।

লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির হেলথ সায়েন্স সেন্টারের পরিচালক মার্ক রায়্যান বলেন, আয়ারল্যান্ডে কোনো সাপ নেই। তার কারণ আবহাওয়া তাদের উপযোগী না হওয়ায় তারা সেখানে পৌঁছতে পারেনি।

শীতল দেশ আয়ারল্যান্ড

শীতল দেশ আয়ারল্যান্ড

সময় তাদের পক্ষে ছিল না। একই কারণে শুধু আয়ারল্যান্ডসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দ্বীপ রাষ্ট্র, যেমন নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকাতেও কোনো সাপ নেই।

শুধু সাপ না, বরফ যুগের পর আয়ারল্যান্ডে কোনো সরীসৃপই প্রবেশ করতে পারেনি, শুধুমাত্র টিকটিকি বাদে। নাইজেল মোনাগানের মতে, আজ থেকে ১০ হাজার বছর পূর্বে প্রবেশ করা এই টিকটিকিগুলোই একমাত্র সরীসৃপ। যা প্রাকৃতিকভাবে আয়ারল্যান্ডে প্রবেশ করতে পেরেছিল।

তবে আগে ছিল না বলেই যে ভবিষ্যতে আয়ারল্যান্ডে কখনো সাপের আবির্ভাব ঘটবে না, সেটা নিশ্চিত করা বলা যায় না। নব্বইয়ের দশক থেকে অনেক আইরিশ শৌখিন ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে আনা সাপের চাষ শুরু করেছিলেন।

তবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর খরচ পোষাতে না পেরে তাদের অনেকে সেসব সাপ বনে-জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। এসব সাপ হয়তো বংশবিস্তার করে এক সময় আয়ারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করতে পারে।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি/হিস্ট্রি

পাঠকের মতামত

Comments are closed.