270297

ইসলামের প্রথম পতাকা ও এর মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব

ইসলামে পতাকার প্রচলন ঘটে হিজরতের সময়। হজরত নবী করিম (সা.) হিজরতের উদ্দেশ্যে যখন মদিনার পথ ধরেন, রাস্তায় বারিদা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত হয়। পুরস্কারের লোভে রাসূল (সা.)-কে ধরতে এসেছিলো। কিন্তু সে মুসলমান হয়ে রাসূল (সা.) এর সঙ্গী হয়ে যান।

বারিদা নবী করিম (সা.)-কে বলেন, মদিনায় প্রবেশকালে আপনার একটি পতাকা থাকা দরকার। তখন নবী করিম (সা.) মাথা থেকে পাগড়ী খুলে, বর্শার মাথায় বেঁধে হজরত বারিদাকে দেন। রাসূল (সা.) মদিনায় প্রবেশের সময় হজরত বারিদা (রা.) সেটিকে পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেন। শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে ওই পতাকা ব্যবহার হয়েছিলো। এটাই ইসলামের প্রথম পতাকা। তবে বারিদা নিজের পাগড়ীকেই পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিলো বলে অনেক বর্ণনায় পাওয়া যায়। (যরকানী, শরহু মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭৩)

ইবনুল আছির আলজাজারি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কামেল’ এ লেখেন, ‘হিজরতের প্রথম বছর সাত মাস অতিবাহিত হওয়ার পর, রাসূল (সা.) স্বীয় চাচা হামজার হাতে পতাকা ওঠিয়ে দেন। পতাকার রং ছিলো সাদা। বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ত্রিশজন। তাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো কুরাইশদের একটি কাফেলাকে ধাওয়া করার জন্য। পথে আবু জাহেলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। কিন্তু মাজদি ইবনে আমর আলজুহানি নামক একজন নেতার মধ্যস্ততায় যুদ্ধ থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকে। মুসলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন আবু মুরছাদ (রা.)। ওই পতাকাই নবী করিম (সা.) সর্বপ্রথম বেঁধেছিলেন।’ (আল কামেল ফীত তারিখ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-১২) তবে দুই বর্ণনায় সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব এভাবে যে, যুদ্ধের পতাকা হিসেবে হামজা (রা.) এর পতাকা ইসলামে সর্বপ্রথম। আর সাধারণ পতাকা হিসেবে হজরত বারিদা (রা.) এর পতাকা প্রথম। আল্লাহ তায়ালাই উত্তম জানেন।

রাসুল (সা.) এর পতাকার রং:

রাসূল (সা.) দু’ধরনের পতাকা ব্যবহার করতেন। ‘রায়া’ ওই পতাকা যা যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির জন্য ব্যবহৃত হতো। এই পতাকার নিচে থেকেই বাহিনী যুদ্ধ করতো। যতক্ষণ পতাকা উড়তো ততক্ষণ যুদ্ধ চলতো। ময়দানে কখনো বিশৃঙ্খলা হলে নিজেদের সৈন্যদলকে চিহ্নিত করার মাধ্যম ছিলো এই পতাকা। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত আলী ও সাদ ইবনে মুআজ (রা.) এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো কালোর ভেতর সাদা দিয়ে ইসলামের কালেমা। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯১)

দ্বিতীয় পতাকা ছিলো ‘লিওয়া’। এটা ছিলো রাষ্ট্রের প্রতীক। রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমামুল মুসলিমিন এই পতাকা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধের ময়দানে এই পতাকা বর্শার অগ্রভাগে বেঁধে রাখা হতো। বদর যুদ্ধে এই পতাকা ছিলো হজরত মুসআব ইবনে উমাইর (রা.) এর হাতে। এই পতাকার রং ছিলো সাদার ভেতর কালো দিয়ে ইসলামের কালেমা।  হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের দিন নবী করিম (সা.) এর হাতে সাদা পতাকা ছিলো।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯২)

দুই রঙের পতাকা ব্যবহারের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সাদা পতাকা ব্যবহার দ্বারা বুঝানো হয়েছে, ইসলাম সহজ-সরল জীবনব্যবস্থা। এর অনুসারীদের জীবন লৌকিকতা মুক্ত। এখানে ভীতিপ্রদর্শন, কঠোরতা ও বক্রতার কোনো স্থান নেই। এমন কি যারা ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম হিসেবে বসবাস করবে, তাদের ওপরও কোনো চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

নবী করিম (সা.) এর যুদ্ধের পতাকার রং ছিলো কালো। কালো হচ্ছে আতঙ্ক ও ভয়ের চিহ্ন। এর দ্বারা বিরোধীদেরকে বার্তা পৌঁছানো হতো যে, যারা সাম্য ও ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের প্রতি ইসলাম কোনো রহম দেখাবে না। তারা শুধু ইসলামের কঠোরতাকে দেখতে পাবে। এক হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) এর পতাকার বর্ণ হলুদ ছিলো। যেমন হজরত সেমাক ইবনে হারব নামক একজন সাহাবি বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.) এর জন্য হলুদ বর্ণের পতাকা দেখেছি।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর-২৫৯৩)

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী করিম (সা.) বনু সুলাইম গোত্রকে লাল বর্ণের পতাকা দিয়েছিলেন। আল্লামা আইনি বলেন, বর্ণনার এই বিরোধগুলোর সমাধান হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে নবী করিম (সা.) বিভিন্ন বর্ণের পতাকা ব্যবহার করতেন। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকা হিসেবে সাদা এবং যুদ্ধের পতাকা হিসেবে কালো বর্ণের পতাকাই নবী করিম (সা.) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন।

রাসূল (সা.) এর পতাকার নাম:

নবী করিম (সা.) স্বীয় পতাকার নাম রেখেছিলেন ‘উকাব’। উকাব আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ হচ্ছে ঈগল। উর্দুতে বলা হয় শাহীন। এই শব্দ দ্বারা নামকরণের কারণ হচ্ছে, ‘উকাব’ পাখিদের সর্দার। কোনো পাখি এর সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস পায় না। ‘উকাব’ নির্ভীকতা, ক্ষীপ্রতা ও সৌখিনতার প্রতীক। নববী পতাকাবাহীদের মাঝেও এই গুণগুলোর সমাহার ঘটেছিলো। তাই এই শব্দে নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও বিভিন্ন দেশের পতাকায় ও বাহিনীর প্রতীকে ঈগলের ছবি ব্যবহার হয়। ঈগল নিয়ে বহু কবিতা ও সাহিত্য রচনা হয়েছে। প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবাল ঈগল নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছেন। মুসলিম যুবকদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘যখন মুসলমান নওজোওয়ানদের ভেতর ঈগলের আত্মা জাগবে বিশ্ব জয়ের নেশায় তারা মত্ত হয়ে যাবে।’

রাসূল (সা.) এর পরবর্তী যুগে ইসলামের পতাকা:

যুদ্ধের পতাকা রাসূল (সা.) এর পরবর্তী যুগেও কালো বর্ণের ছিলো। তবে রাষ্ট্রীয় পতাকায় সময়ে সময়ে পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই যুগ অর্থাৎ রাসূল (সা.) ও তাঁর চার খলিফা এবং উম্মাইয়াদের সময়ে পতাকার রং আগের মতোই সাদা ছিলো। আব্বাসীয়াদের আমলে পতাকার রং ছিলো কালো। শীয়া মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত ফাতেমিদের পতাকার রং ছিলো সবুজ। উসমানীয়দের পতাকা ছিলো লালের মাঝে অর্ধচন্দ্র।

ইসলামে পতাকার মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব:

রাসূল (সা.) বিরোধীদের সঙ্গে সরাসরি প্রায় সাতাশটি যুদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রিয় সহচরদের দ্বারা চল্লিশেরও অধিক যুদ্ধ করিয়েছেন। সবকটি যুদ্ধে নবী করিম (সা.) গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে পতাকা বহনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সাতাশটি যুদ্ধের অন্যতম একটি ছিলো মুতার যুদ্ধ। বহু কারণে যুদ্ধটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এতদিন মুসলমানদের যুদ্ধ ছিলো মক্কার মুশরিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। যারা যুদ্ধে কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী ছিলো না। অন্যদিকে মুতার যুদ্ধ ছিলো রোমানদের বিরুদ্ধে। যারা ছিলো তৎকালিন বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত যোদ্ধ।

দ্বিতীয়ত, এতদিন যত যুদ্ধ হয়েছে, তা ছিলো হেজাযের ভূমিতে। অর্থাৎ মদিনার আশপাশ এলাকায়। কিন্তু এবারের যুদ্ধ মদিনা থেকে বহু দূর সিরিয়ার অঞ্চলে। নবী করিম (সা.) পর্যায়ক্রমে চারজন সেনাপতি ঠিক করলেন। প্রথম সেনাপতি ছিলেন যায়েদ ইবনে হারেছা। তিনি পতাকা নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তার শাহাদাতের পর রাসূল (সা.) এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.) সেনাপতি হলেন। তিনি প্রথমে ডান হাত হারান। তখন বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর বাম হাতও কাটা পড়ে। তিনি তখন নিজের শরীরের সঙ্গে পতাকা চেপে ধরেন। তারপরও পতাকা ভুলুণ্ঠিত হতে দেননি। এভাবে তিনজন সেনাপতি শহিদ হয়েছেন, কিন্তু ইসলামের পতাকাকে ভুলুণ্ঠিত হতে দেননি। এটাই প্রমাণ করে পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পতাকা শুধু একটি কাপড় নয়। কোনো জাতির পরিচয়ের জন্যও শুধু পতাকা নয়। বরং পতাকা হচ্ছে, জাতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী। ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সাম্য ও ভ্রাত্বের দাওয়াতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। আল্লাহর দ্বীনের গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। জালেমকে প্রতিহত করা। মাজলুমকে সুরক্ষা দেয়া। তাই ইসলামের পতাকার পতন মানে মুসলমানদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়া। অন্যদের সামনে মুসলমানদের নতজানু হওয়া। এই অন্তর্নিহিত কারণেই সাহাবায়ে কেরাম কখনো যুদ্ধের ময়দানে পতাকা ভুলুণ্ঠিত হতে দিতেন না। বাহ্যিক কারণও ছিলো। যে বাহিনীর পতাকার পতন ঘটে, ধরে নেয়া হয় তারা পরাজিত হয়েছে। তখন সৈন্যবাহিনী যুদ্ধের হাল ছেলে দেয়।

পতাকা নিয়ে সমকালিন কিছু বিধিবিধান:

বর্তমান সময়ে দেশের সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার লাশকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ইসলামে এর বৈধতা আছে কিনা তা অনেকে জানতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের মত হচ্ছে, ‘মৃতব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তার লাশ, খাটিয়া বা গাড়িকে অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মৃতব্যক্তির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা এবং তাকে সম্মান জানানো। শরীয়তের দৃষ্টিতে এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে বিশেষ কোনো কালারকে আবশ্যক মনে করা ঠিক নয়। উত্তম হচ্ছে সাদা কাপড় ব্যবহার করা।

জাতি ও রাষ্ট্রের বিশেষ সেবা আঞ্জাম দেয়ার খাতিরে কারো কফিনকে যদি জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় তাহলে এটা বৈধ হবে। কারণ, এটাকে সওয়াবের কাজ মনে করে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এমনিভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ মুসলমানের কাফনের ওপর যদি পতাকা দেয়া হয় এই উদ্দেশ্যে যে, তার দ্বারা যেন অন্যরা স্বাধীনতার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয় তাহলেও এর সুযোগ আছে। তবে উত্তম হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির কফিন ইত্যাদিতে পতাকা না দেয়া। প্রয়োজনে সম্মানের খাতিরে সাদা কাপড় দেয়া। তবে কোনো পতাকা যদি ভাষাগত বা আঞ্চলিক জাতীয়তা কিংবা শরীয়ত বিরোধী কাজের প্রতীক হয় তাহলে তা দ্বারা মৃতব্যক্তি বা তার কফিন ঢাকা জায়েজ হবে না। ’ (দারুল ইফতা, জামিয়া উলুমিয়া ইসলামিয়া আল্লামা বিননূরী টাউন, অনলাইন ফতোয়া নম্বর-১৪৪০১০২০০২৩৩)

দ্বিতীয় বিধান হচ্ছে জাতীয় পতাকাকে সালাম দেয়া। এ ব্যাপারে মত হচ্ছে, ‘পতাকার সামনে দাঁড়ানো বা সালাম দেয়া নির্দিষ্ট বাহিনীর আইন। তাই এমন করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে পতাকার সামনে ঝুঁকা জায়েজ হবে না। কারণ, ঝুঁকে কোনো বস্তুকে সম্মান দেখাতে শরীয়তে নিষেধ করা হয়েছে। তবে ঝুঁকে সম্মান প্রদর্শন করলেও এটাকে শিরকি আমল সাব্যস্ত করা যাবে না’। ((দারুল ইফতা, জামিয়া উলুমিয়া ইসলামিয়া আল্লামা বিননূরী টাউন, অনলাইন ফতোয়া নম্বর-১৪৪১০৪২০০১৬৫)

পাঠকের মতামত

Comments are closed.