270090

বিশ্বখ্যাত এক দেশ, ‘সূর্যাস্তের রাজ্য’ নামেই তার পরিচিতি

আফ্রিকা মহাদেশের একদম উত্তর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মরোক্কো নামের দেশটি বহু কারণে বিশ্বখ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মিনারবিশিষ্ট মসজিদের অবস্থান এই দেশেই।

নৃবিজ্ঞানীরা এখানে তিন লাখ বছরেরও বেশি পুরনো হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন। সম্ভবত এই মরোক্কোর উত্তর উপকূল দিয়েই ক্রো ম্যাগনন মানুষ নামে পরিচিত আমাদের পূর্বসূরীরা আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই ঐতিহ্যবাহী মরোক্কো দেশটি সম্পর্কে জেনে নিন-

মরক্কোর বর্ণিল ইতিহাসের পাশাপাশি জানাবো ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতাগুলো কেন তাদের রূপকথায় এই অঞ্চলটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সূর্যাস্তের রাজ্য নামে খ্যাত মরোক্কো সম্পর্কে জানাবো।

প্রায় ৭ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ২ লাখ ৭৫ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশ মরোক্কো। এই দেশের জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটির কিছু বেশি। মরোক্কো নামে এই রাষ্ট্রটির যাত্রা শুরু হয় খ্রিস্টাব্দ অষ্টম শতকে। একসময় স্পেন ও পর্তুগালের অন্তর্ভুক্ত বিস্তীর্ণ এলাকা এই মরোক্কো রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বর্তমান মরোক্কোর পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং উত্তর দিক ভূ-মধ্য সাগরের সুনীল জলরাশি দিয়ে ঘেরা। দেশটির পূর্ব দিকের সীমান্তটি আলজেরিয়ার সঙ্গে।

মরোক্কোর এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ

মরোক্কোর এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ

দক্ষিণের স্বীকৃত রাষ্ট্র হিসেবেই মৌরিতানিয়া থাকলেও সাহারা মরুভূমির অন্তর্গত বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মরোক্কো এবং মৌরিতানিয়া মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। এই বিরোধের কারণে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মরোক্কোর প্রায় তিন লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকার পুরাপুরি জনশূন্য।

মরোক্কো বর্তমান রাজধানীর রাবাত শহরে অবস্থিত হলেও, এক হাজার বছরের বেশি সময় মারাকেশ নামক শহরটি ছিল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। এই রাজধানীর নামে অপভ্রংশ হয়ে দেশটির ল্যাটিন নাম মরোক্কো হয়ে গেছে।

ভাষাবিদদের ধারণা মরোক্কো শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে স্থানীয় বার্বার সভ্যতার মানুষদের ভাষা থেকে। সেই হিসেবে এর অর্থ দেবতাদের শহর। আরবি ভাষায় মরোক্কোর পুরো নাম আল্‌মাম্‌লাকাতুল মাগরিবিয়্যা এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, সূর্যাস্তের রাজ্য।

প্রাচীন আমলে ভূমধ্যসাগরের উপকূলের স্থাপিত সভ্যতাগুলোর ধারণা অনুযায়ী, পৃথিবীর সীমানা আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চদশ শতকে আমেরিকা আবিষ্কারের পর এই ধারণা পাল্টে যায়।

এই ভুল ধারণার  কারণে ব্রোঞ্জ এবং লৌহ যুগের ভূমধ্য সাগরের তীরে যেসব সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। তাদের রূপকথা এই মরোক্কো অঞ্চলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

মরোক্কো

মরোক্কো

এদের মধ্যে গ্রীক, রোমান, ফিনিসীয় এবং মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম। এর মধ্যে গ্রীক রূপকথা অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগে একসময় টাইটানদের রাজত্ব ছিল।

এদের রাজা ছিলেন ক্রোনাস নামের এক টাইটান। এই টাইটানের ঔরসজাত সন্তানরা একপর্যায়ে পিতা ক্রোনাস এবং তার টাইটান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে।

ক্রোনাসের সন্তানদের মধ্যে জিউস, এরপা, পসেইডন এবং হেডিস অন্যতম। এই চরিত্রগুলো গ্রীক রূপকথায় অদ্বিতীয় দেবদেবী হিসেবে সুপরিচিত। টাইটান এবং অলিম্পিয়দের মধ্যে এই যুদ্ধে এটলাস নামক টাইটানের কারণে জিউস ও তার বাহিনীর বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

ফলে জিউস যুদ্ধে জয়লাভের পর এটলাসকে বেশ কঠিন সাজা দিয়েছিলেন। জিউসের দেয়া শাস্তি অনুযায়ী এই মরোক্কোর উপকূলে দাঁড়িয়ে এটলাস পৃথিবীর উপর আকাশটাকে নিজের কাঁধে ধরে রেখেছেন।

তার সম্মানেই মরোক্কোর উপকূলবর্তী জলরাশির নাম রাখা হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। আর উত্তর আফ্রিকা জুড়ে বিস্তৃত প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতমালার নাম দেয়া হয়েছে এটলাস পর্বতমালা।

গ্রীকদের হেরাক্লিস এই এটলাসকে দিয়েই স্বর্গের বাগান থেকে স্বর্ণের আপেল সংগ্রহ করেছেন। এই অভিযানের সময় মরোক্কোর যে গুহায় হেরাক্লিস বিশ্রাম নিয়েছিলেন, তার নাম রাখা হয়েছে এই বীরের নামানুসারে।

মসজিদ

মসজিদ

হেরাক্লিস গ্রীক বীরদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। গ্রীক রূপকথার এই বীরপুরুষ তার রোমান নামে বেশি পরিচিত। রোমানরা হেরাক্লিস নাম দিয়েছিলেন হারকিউলিস। এই হারকিউলিসের গুহা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের সঙ্গে থাকুন।

আগে জানিয়েছি, নৃবিজ্ঞানীরা এই মরোক্কোয় তিন লাখ বছরের বেশি পুরনো মানুষের ফসিল খুঁজে পেয়েছেন। দেশটির আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত জেবেল ইরহুদ এলাকায় ২০০৮ সালে ফসিলটি আবিষ্কার করা হয়।

ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, ওই সময় মরোক্কোর পরিবেশ বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি মৃদুভাবাপন্ন এবং উর্বর ছিল। ফলে বিবর্তনের ধারায় পূর্ব আফ্রিকার তৃণভূমি এলাকায় আবির্ভাবের পর পরই আদি মানুষ পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছিল।

পায়ে হেঁটে বর্তমান ইথিওপিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত পৌঁছাতে সেই মানুষগুলোর কয়েক হাজার বছর সময় লেগেছিল। বিজ্ঞানীদের ভাষায় প্রো ম্যাগনম নামে পরিচিত এই মানুষগুলো এক এক প্রজন্মে গড়ে ৫০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব অতিক্রম করেছে।

মরোক্কো দেশটি

মরোক্কো দেশটি

কালের পরিক্রমায় এদের হাতে আটলান্টিক উপকূলে মানব সভ্যতা গড়ে উঠছে। আর বিজ্ঞানীরা এই সভ্যতার নাম দিয়েছেন এটোলিয়ান সভ্যতা। মরোক্কোসহ উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতার মানুষই প্রথম পান পাতা আকৃতির তীর এবং বল্লমের ফলা তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল।

তাছাড়া হাড় থেকে মাংস চাঁছার হাতিয়ারও প্রথম এই সভ্যতার জনপদে খুঁজে পাওয়া গেছে। শুধু তাই না, নৃবিজ্ঞানিদের ধারণা অনুযায়ী, এই সভ্যতার মানুষই প্রথম কৌড়ি জাতীয় ছোট ঝিনুকের খোলস ফুটো করে পরিধেয় অলংকার তৈরির প্রচলন করেছিল।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরনো অলংকারটি এই উত্তর আফ্রিকা থেকেই আবিষ্কার করা হয়েছে। এটোলিয়ান সভ্যতার তৈরি সেই গলার হারটির বয়স প্রায় ৮২ হাজার বছর। আনুমানিক ২২ হাজার বছর আগে ইব্রু মৌরিসিয়াম সভ্যতা মরোক্কোর এটোলিয়ান সভ্যতার স্থলাবিশিদ্ধ হয়। ইতিহাসে মরোক্কো অঞ্চলটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ফিনিশীয় সভ্যতার লেখনীতে।

এই সভ্যতার মানুষজন প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল থেকে দক্ষিণ উপকূলে অভিবাসনে বাধ্য হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের মাঝেই অভিবাসনের কারণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

কেউ দাবি করেন, বহিঃশত্রুর হামলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছিল। আবার কারো দাবি অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলের জলবায়ুতে বিশাল পরিবর্তন আসাতেই অভিবাসনে বাধ্য হয়েছিলেন ফিনিশীয়রা।

লাল দালান

লাল দালান

উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া, নাইজেরিয়া এবং মরোক্কোর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল জুড়ে একাধিক জনপদ স্থাপন করে ফিনিশীয় অধিবাসীরা। এ জনপদগুলো সামগ্রিকভাবে কারতিজিয় সভ্যতা নামে পরিচিত।

কারতিজিয় সভ্যতার মানুষদের নাম বার্বার। স্থানীয় এই আদিবাসী মানুষগুলো এখনো উত্তরআফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হিসেবে টিকে আছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ডিএনএ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই বার্বার বংশোদ্ভূতদের সঙ্গে উত্তর মেরু বৃত্তের ভেতর বসবাসকারী সামি জনগোষ্ঠীর বেশ মিল খুঁজে পেয়েছেন।

তাই তাদের ধারণা, মেরু বৃত্তের ভেতর বসবাসকারী মানুষদের পূর্বসূরিরা এই উত্তর আফ্রিকা থেকেই তাদের উর্ধমুখী যাত্রা শুরু করেছিলেন। কয়েক হাজার বছর আগের সেই অভিযাত্রীরা সম্ভবত মরোক্কোর উপকূলে অবস্থিত স্ট্রেইট অব জিভ ট্রাক্টর পেরিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.