269702

পাগলা রাজার ‘তুঘলকি কাণ্ড’, লঘু পাপে দিতেন গুরু দণ্ড

তুঘলকি কাণ্ড শব্দের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। এই প্রবাদের অর্থ হলো বড়সড় কোনো ঘটনা বা অন্যায় আর জোর জবরদস্তির কাণ্ড। তবে এই প্রবাদ ঠিক কবে থেকে চালু হলো, আর এই প্রবাদ সৃষ্টির ইতিহাস কি?

এর দুটো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দুই ব্যাখ্যার সঙ্গে এই তুঘলক রাজবংশেরই দুই শাসকের নাম জড়িত। প্রথমজন সুলতান মুহম্মদ আদিল বিন তুঘলক শাহ, যাকে মুহম্মদ বিন তুঘলক বলেই চিনি আমরা।

সুলতান পরিচিতি

সুলতান মুহম্মদ আদিল বিন তুঘলক শাহ এর অপর নাম শাহজাদা ফখর মালিক, জুনা খান। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ রাজবংশের শাসক ও দিল্লির সুলতান ছিলেন। মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ১৩২৫ সালে তার বাবা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যু হলে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।

মুহাম্মদ বিন তুঘলক যুক্তি, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানে একজন পন্ডিত ছিলেন এবং শারিরীক বিজ্ঞান এবং ওষুধবিজ্ঞানে তার ভালো ধারণা ছিল। এছাড়াও তুর্কিশ, আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষা তার আয়ত্তে ছিল।

 মুহম্মদ বিন তুঘলক

মুহম্মদ বিন তুঘলক

মুলতানে জন্মগ্রহণকারী তুঘলক বংশের এই শাসক সম্ভবত মধ্যযুগের সবচেয়ে শিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ্য সুলতান ছিলেন তবে তার পাগলাটে এবং পাশবিক আচরনের কারণেও তার কূখ্যাতি রয়েছে।

চতুর্দশ শতাব্দীর দিল্লীর এই সুলতান ছিলেন বৈপরীত্যে ভরা এক নাটকীয় চরিত্র। একাধারে তিনি ছিলেন মহানুভব এবং নিষ্ঠুর, বিদ্বান এবং বোকা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ভীষণ দরকম ব্যর্থ।

সবকিছু মিলিয়েই ইতিহাসে ‘পাগলা রাজা‘ নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন তিনি। তার এই পাগলাটে কীর্তিকলাপই ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিতি পায়। এই মুহম্মদ বিন তুঘলকের ন্যায়পরায়ণতার এক উদাহরণ দেই শুনুন।

তুঘলকি কাণ্ডের নমুনা

একদিন তিনি জঙ্গলে গেলেন শিকার করতে। অতঃপর তিনি ভুল করে আঘাত করে বসলেন এক দরিদ্র কৃষক সন্তানকে। প্রচণ্ড প্রতাপশালী সুলতান কাজির কাছে গিয়ে অকপটে নিজের দোষ শিকার করলেন। কাজিকে নির্দেশ দিলেন তাকেও আর সবার মতো বিচার করতে।

লাখো মানুষকে হত্যা করেন এই সুলতান

লাখো মানুষকে হত্যা করেন এই সুলতান

অতঃপর কাজি তাকে সাজা দিলেন। সেই কৃষকের সন্তানের হাতে চাবুকের মার খাওয়ার নির্দেশ দিলেন কাজি। দুর্দান্ত সেই সুলতান এই সাজা মাথা পেতে নিলেন। নিশ্চয় তাকে উদার ভাবছেন? তবে ন্যায়পরায়ণ আর মহানুভব এই সুলতানকিম নিষ্ঠুরও ছিলেন না।

সামান্যতম বিদ্রোহের আভাস পেলে সন্দেহভাজন বিদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারীকে হত্যা করে তার মৃতদেহ দূর্গতোরণের বাইরে টাঙ্গিয়ে রাখতেন কিংবা ছুঁড়ে দিতেন হিংস্র হাতির পালের সামনে। এই সমস্ত হাতির দাঁতে ধারালো ব্লেড জাতীয় কিছু লাগানো থাকতো। যা দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেত মানুষগুলো।

তখন মোঙ্গল আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল রাজধানী দিল্লি। ফলে দিল্লি থেকে ৭০০ মাইল দূরে দেবগিরি বা দৌলতাবাদে রাজধানী স্থাপন তিনি নিরাপদ মনে করলেন। মুহম্মদ বিন তুঘলক দেবগিরিকে ইসলামী সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

এ উদ্দেশ্যে তিনি উলেমা ও সুফি-সাধকদের সেখানে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সুলতান দেবগিরিতে নতুন নগর ও প্রাসাদ নির্মাণ করলেন।

দৌলতাবাদ দুর্গ

দৌলতাবাদ দুর্গ

দিল্লি হতে দেবগিরি বা দৌলতাবাদ পর্যন্ত ৭০০ মাইল দীর্ঘ সড়ক নির্মিত হলো। তিনি পথিকদের সুবিধার জন্য রাজপথের পার্শ্বে বৃক্ষরোপণ ও কূপ খনন করেন এবং বিনামূল্যে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহের জন্য সরাইখানা স্থাপিত হয়।

এসব ব্যবস্থা করে ১৩২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক তার নতুন পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য না কৌশল বাতলেন। এজন্য তিনি সুফি-সাধকসহ সমাজের উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ, প্রভাবশালী অভিজাত ও সভাসদদের নতুন রাজধানীতে গমনের আদেশ দিলেন। তিনি নিজেও দৌলতাবাদে গমন করলেন।

তবে এসব করতে গিয়ে জনগণের উপর অত্যাচারও কম করেননি তিনি। এতসব বন্দোবস্ত করতে জনগণের উপর আরোপ করেন অপরিমিত কর, ঘাড় ধরে প্রজাদের নিয়ে যান দেবগিরিতে। দিল্লিকে জনমানবহীন করে ফেলেছিলেন তিনি।

তার শাসন আমলেই মরোক্কোর বিশ্ববিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবন বতুতা তার সম্রাজ্য ভ্রমণ করেন। তিনি এই পাগলা রাজার সম্পর্কে সর্বাধিক বিতর্কের অবতারণা করেছেন।

ইবনে বতুতা বলেন, দিল্লি নগরী মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন যে, সুলতানের আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ‘এক পঙ্গু ব্যক্তিকে বেলিস্তার সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং একজন অন্ধ ব্যক্তিকে দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।’

আর তাই এই অদ্ভুত বৈপরীত্যে পূর্ণ পাগলা রাজার দক্ষযজ্ঞের জন্য তার কাণ্ডকারখানাকে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলে জেনেছে ইতিহাস। এই প্রবাদের দ্বিতীয় পুরুষ মুহম্মদ বিন তুঘলকেরই বংশধর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক।

১৩৬০ সালে ফিরোজশাহ তুঘলক উড়িষ্যা অভিযান করেন। তিনি পুরীর পুনঃতৈরীকৃত জগন্নাথ বিগ্রহ নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেন। এই সেই জগন্নাথ বিগ্রহ যা এর আগে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী একবার ধ্বংস করেছিলেন।

ফেরার পথে জাজ নগরে এসে ফিরোজ শাহ জানতে পারলেন সেখানকার লোকেরা ভয়ে সমুদ্রের একটি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে। তখন তিনি সৈন্য নিয়ে সেই দ্বীপে গেলেন। সেখানে এক লাখ বিশ হাজার হিন্দুকে হত্যা করলেন যেটাকে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। সেই থেকেই বড় কোনো ঘটনাকে প্রবাদ আকারে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ বলা হয়।

ন্যায়পরায়ণও ছিলেন তিনি

ন্যায়পরায়ণও ছিলেন তিনি

মুহাম্মদ বিন তুঘলক অধিকাংশ সময়ই লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিতেন। এর থেকে ধনী, গরীব, মুক্ত কিংবা কৃতদাস কেউই রেহাই পেতেন না। এছাড়াও তার আচরণ ছিল রহস্যময়। কথিত আছে একবার কিছু প্রজা তার নামে বিদ্রুপপূর্ণ আজেবাজে কথা লিখে খামে ভরে শহরে প্রচার করেছিল।

এতে করে তিনি সুলতান ক্ষিপ্ত হন এবং সিদ্ধান্ত নেন দিল্লি থেকে সব প্রজাদের বের করে দিবেন। শহরে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেয়া হল আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রজাদেরকে শহর খালি করে দিতে হবে। এর ফলে বেশিরভাগ মানুষ ভয়ে শহর ছেড়ে চলে গেলেও অনেকে আত্নগোপন করে থাকল।

সময়সীমা পার হলে তিনি শহর তল্লাশি করার হুকুম দেন। সেখানে যাদের পাওয়া যায় তাদের হয় হত্যা করা হয়। আর না হয় টেনে হিঁচড়ে পার্শবর্তী শহর দৌলতাবাদে রেখে আসা হয়। পুরো শহর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর একদিন তিনি তার প্রাসাদের ছাদে উঠে যখন দেখলেন যে শহরের কোথাও আগুন জ্বলছে না তখন তিনি বলে ওঠেন ‘এখন আমার মন শান্ত হয়েছে, রাগ কমেছে’।

মুদ্রা ব্যবস্থা

মুহাম্মদ বিন তুঘলক তৎকালীন সমসাময়িক অন্যান্য সম্রাজ্যের মতো মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার পূর্বসূরীদের চেয়েও অনেক বেশি মুদ্রা বাজারে ছাড়েন। তার চালুকৃত স্বর্ণমূদ্রাগুলো ওজনে অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে অনেক ভারী ছিল এবং আরবি হরফের ক্যালিগ্রাফি সংযুক্ত ছিল।

এই মুদ্রাকে বলা হত টংকা। তিনি রূপার মুদ্রাও চালু করেছিলেন যা আধুলি নামে পরিচিতি পায়। তবে এই মুদ্রা চালুর সাত বছরের মধ্যে জনগণের কাছে এর অগ্রহণযোগ্যতার জন্য তুলে নিতে বাধ্য হন। এরপর সুলতান কাগজে ছাপা মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরবর্তীতে কিছু প্রভাবশালী প্রজা এবং কয়েকজন সভাসদের বিরোধিতার মুখে তিনি এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য হন।

তার আমলের মুদ্রা

তার আমলের মুদ্রা

ধর্মনীতি

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ধর্মনীতি অনেক উদারপন্থি ছিল। তার রাজত্বে হিন্দু, মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নির্বিঘ্নে বসবার করতেন। হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের প্রসারে তিনি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

সাম্রাজ্য ভেঙে পড়া

মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩৫১ সালে বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু রাজ্যের ঠাট্টা অঞ্চলে সুমরু গোষ্ঠির সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবিত থাকা অবস্থাতেই তার রাজ্যে ভাঙনের সূত্রপাত হয়। তার রাজত্বকালেই দাক্ষিনাত্যের মালভূমি অঞ্চল তার রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশের শাসক প্রলয়ভেমা রেড্ডি ও মুসুনুরি কাপানিডু তাদের নিজ নিজ শাসিত অঞ্চল দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত করাতে সক্ষন হন। এতে করে দিল্লির অধীনস্থ অন্যান্য অঞ্চলসমূহের শাসক এবং তাদের গভর্নরদের কাছে দিল্লির মর্যাদা কমে যায়। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের ভাঙন অবশ্যম্ভাবি হয়ে পড়ে।

পাঠকের মতামত

Comments are closed.